![]() |
প্রচ্ছদের ছবি : পিন্টারেস্ট |
দক্ষিণ পাড়ার গালির মুখে লম্বা একটা ছায়া পড়ল। আমরা প্রায় সঙ্গে সঙ্গে অতিরিক্ত সাবধান হয়ে উঠলাম। গলির অদূরে বয়ষ্ক এক আমগাছ; তার প্রশস্ত শরীরের আড়ালে নিজেদেরকে লুকিয়ে ফেললাম আমরা। আতিক ফিসফিস করে বলে উঠল, ‘কেউ মনে হয় আসিচ্ছে!’ আমি মুখে হাত দিয়ে ইশারায় আতিককে চুপ থাকতে বললাম। সুমন এমনভাবে গাছটির সঙ্গে হেলান দিল, যেন সেও গাছের অংশ। সুমনের দেখাদেখি আমারাও। আমাদের নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। আমাদের সুঁচালো দৃষ্টি গলির মুখে।
সন্ধ্যায় একখণ্ড বাঁকা চাঁদ উঠেছিল পশ্চিম আকাশে। শাওয়াল মাসের চাঁদ। আমরা অবশ্য বলি ঈদের চাঁদ। সেই চাঁদ ডুবে গিয়ে এখন ঘোর অন্ধকার। মধ্য রাত। অন্ধকারে ছায়ার অবয়ব ঠাহর করা কঠিন। আমাদের সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি তবু চিনে ফেলে ছায়ার মানুষটাকে। সে হারুন।
হারুন বয়সে যুবক। পেশায় ভ্যানচালক। অনেকটাই পরিবারহীন। বিয়ে থা সে করেনি এখনো। ঘরে বুড়ো বাপ ছাড়া তার কেউ নেই। মা মরেছে অনেক আগেই। দক্ষিণ পাড়ার শেষ মাথায় হারুনের বাড়ি। বাড়িও ঠিক নয়, খড়ের চাল দেওয়া ছোট্ট একটি ঝুপড়ি, জসীম উদদীনের ভাষায়— ‘বাড়ি তো নয় পাখির বাসা!’
সেই পাখির বাসা থেকে বের হয়ে এত রাতে হারুন যায় কোথা? তার হাতে কিছু একটা দেখা যায়। আমরা আমাদের দৃষ্টিটাকে প্রায় শকুনের পর্যায়ে উন্নীত করি এবং বুঝতে পারি, ওটা মাছ ধরার জাল। এত রাতে হারুন জাল নিয়ে কোথায় যায়?
আমরা কৌতুহলী হয়ে হারুনের পিছু নিই।
মাঝে মাঝে রাতের বেলা আমরা এইসব কর্মকাণ্ড করি। অর্থাৎ গভীর রাতে কোথায় কে কী করছে তা লুকিয়ে লুকিয়ে অবলোকন করি। এ আমাদের নতুন নেশা। বারো-তের বছর বয়সী কিশোরদের নাকি এরকম নানান নেশায় পেয়ে বসে। বড়রা বলে এই বয়সীদের মতো বালাই নাকি পৃথিবীতে নাই। সে যাইহোক, যে রাতে বাইরে আমরা দেখার মতো কিছুই খুঁজে পাই না, সে রাতে এর-ওর জানালায় ফুচকি মারি। কত অদ্ভূত অদ্ভূত দৃশ্য যে দেখি! শরমযোগ্য সেসব দৃশ্য।
আজ আমাদের শিকার হারুন।
হারুন বিড়ালের মতো গুটি গুটি পায়ে গাঁয়ের শেষ মাথায় বড় পুকুরের পাড়ে গিয়ে দাঁড়ালো। এ দিক ও দিক সন্তর্পণে দেখে নিলো। তারপর হাতের জালের এক অংশ কনুইয়ে জড়ালো, বাকি অংশ দুই হাতে শক্ত করে ধরে ছুঁড়ে মারল পুকরে। জাল ফেলল হারুন। তারপর খানিকবাদে টেনে তুলল জাল। আমরা ঘোলাটে অন্ধকারে দেখতে পেলাম, জালের ভেতর ছটফট করছে দুটো চকচকে রূপালি রঙের রুই মাছ।
আমাদের বিস্ময়ের সীমা রইল না। হারুন এভাবে মাছ চুরি করে!
জাল থেকে মাছ দুটো ছাড়িয়ে, পুকুর পাড়েরই ছোট্ট খেজুর গাছ থেকে দুটো পাতা ছিড়ে নিয়ে মাছ দুটোর কানকোর মধ্যে ঢুকিয়ে বেঁধে ফেলল হারুন। তারপর জাল কাঁধে নিয়ে মাছ দুটো হাতে ঝুলিয়ে হাঁটা দিলো সে।
কিন্তু হারুন যেদিকে হাঁটা দিল, সেটা দেখে আমার বুকের ভিতর ধক করে উঠল! সুমন আমার হাতে চাপ দিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠল, ‘ক্যা রে মিন্টু, তোরকে বাড়ির দিকে ক্যাম্বা যাচ্চে রে!’
আমরা গোপনে অনুসরণ করতে থাকি হারুনকে।
হারুন সত্যি সত্যি আমাদের বাড়ির উঠোনে গিয়ে দাঁড়ায়। মা যে ঘরে ঘুমায় সেই ঘরের জানালায় মৃদু টোকা দেয়। ঠক ঠক। সাপের মতো হিসহিসে গলায় বলে, ‘জুলেখা… ও জুলেখা!’
জুলেখা আমার মা। বিধবা। বয়স কম। বছর দুই হলো আমার বাপ মারা গেছে। তারপর থেকে আমাদের নানা কষ্ট। মা কী করে কী করে জানি সংসার চালায়। গাঁয়ের মানুষজন ভালো বলে না। বলে, জুলেখার চরিত্র খারাপ। হারুনকে জড়িয়েও মানুষ হরেক কথা বলে।
মা দরজা খুলে উঠানে এসে দাঁড়ায়। হারুন তার হাতে রুই দুটো তুলে দেয়। ‘কাল ঈদ। অ্যানা মাছের পোলাও করিস। তোর হাতের পোলাও খুব স্বাদ হয় রে!’
জবাবে মা কিছু বলে কি না আমরা শুনতে পাই না। মাছ দুটো নিয়ে তাকে ঘরে ঢুকে যেতে দেখি।
0 Comments
Post a Comment