পৃথিবীর বিরল ব্যতিক্রম এক দেশ এই বাংলাদেশ। এখানে ‘সুন্দর’ বেশিদিন বাঁচে না। ‘সুষ্ঠু’ বেশিদিন টেকে না। ‘স্বাভাবিক’ পালিয়ে যায় খুব সহজেই। যা কিছু ‘নিয়মতান্ত্রিক’ তা এখানে আটকা পড়ে অনিয়মের বেড়াজালে। এ এক অদ্ভূত অনিষ্টকর চক্র। এই চক্র থেকে যেন রেহাই পায় না কেউ, কোনোকিছুই। ভাবা গিয়েছিল, স্কুল কেবিনেট নির্বাচন অন্তত মুক্ত থাকবে এই রাহুগ্রাস থেকে। কিন্তু সে আশার গুড়ে বালি। মাত্র পাঁচ বছর আগে শুরু হওয়া এই অতি সুন্দর ব্যবস্থাতেও কালিমা লাগতে শুরু করেছে। প্রশ্ন উঠেছে, স্কুল কেবিনেট নির্বাচন থেকে শিশুরা আসলে কী শিখছে?

গত মাসে দেশের ২২ হাজার ৯৬১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও দাখিল মাদ্রাসায় মহাসমারোহে স্কুল কেবিনেট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে, ১৬ হাজার ২৪৫টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ৬ হাজার ৭১৬টি দাখিল মাদ্রাসা রয়েছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে এক লাখ ২৯ হাজার ৯৬০টি পদের জন্য দুই লাখ ৩১ হাজার ১২৬ এবং মাদ্রাসা পর্যায়ে ৫৩ হাজার ৭২৮টি পদের জন্য ৯৩ হাজার ৭১০ শিক্ষার্থী এ নির্বাচনে অংশ নিয়েছে।

এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অনেক নেতিবাচ সংবাদ গণমাধ্যমে আসতে দেখা গেছে। যেমন স্কুলের পরিচালনা পরিষদ ও দলীয় প্রভাব কিংবা হস্তক্ষেপ, শিক্ষকদের পছন্দ-অপছন্দ, মতামত, স্থানীয় ছাত্র রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি, প্রভাবশালীর ছেলেমেয়েকে প্রার্থী করা ইত্যাদি। সঙ্গতকারণে এই প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সমাজের সচেতন মানুষরা ইতিমধ্যে প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন যে, স্কুল কেবিনেট নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কি সমাজের জন্য, জীবনের জন্য অপরিহার্য ও অবশ্যই শিক্ষণীয় মূল্যবোধগুলো শিখছে? তারা কি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের শিখন, লালন, পরমতসহিষ্ণুতা শিখতে পারছে? সম্ভবত না। বরং ক্ষমতার লোভ, নির্বাচিত সদস্য হবার চিন্তা, এলাকাপ্রীতি, দলীয় টান, প্রভাবশালীদের সন্তান-আত্মীয়প্রীতি, গভর্নিং বডির খায়েশ পূরণের প্রচেষ্টা, সহপাঠী বন্ধু-পাড়া প্রতিবেশী-স্কুলের বড়ভাইদের মধ্যে ভেদাভেদ, দূরত্ব, দ্ব›দ্ব, মনোমালিন্য ইত্যাদি কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদেরকে গ্রাস করতে দেখা গেছে। নির্বাচিত শিক্ষার্থীদেরকে দেখা গেছে পরবর্তী বছর কীভাবে নির্বাচিত হওয়া যাবে তার কৌশল নির্ধারণে তারা মহাব্যস্ত। পড়াশুনা হয়ে পড়েছে তাদের কাছে গৌণ!

অথচ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত স্টুডেন্টস কেবিনেট ম্যানুয়াল-২০১৫'এ স্টুডেন্টস কেবিনেট গঠনের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে: শিশুকাল থেকে গণতন্ত্রের চর্চা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, অন্যের মতামতের প্রতি সহিষ্ণুতা এবং শ্রদ্ধা প্রদর্শন, বিদ্যালয়ের শিখন শিখানো কার্যক্রমে শিক্ষকমণ্ডলীকে সহায়তা করা, বিদ্যালয়ে ১০০% ছাত্র ভর্তি ও ঝরে পড়া রোধে সহযোগিতা করা, শিখন শেখানো কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে অভিভাবকদের সম্পৃক্ত করা, বিদ্যালয়ের পরিবেশ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা ইত্যাদি। এসব উদ্দেশ্য কতটা পূর্ণতা লাভ করেছে তা এখন গবেষণার দাবি রাখে।

অপরদিকে নির্বাচিত কেবিনেট মেম্বারদের দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে: পরিবেশ সংরক্ষণ (বিদ্যালয়,আঙিনা ও টয়লেট পরিষ্কার এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা), পুস্তক এবং শিখন সামগ্রী, স্বাস্থ্য, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি, পানি সম্পদ, বৃক্ষ রোপন ও বাগান তৈরি, অভ্যর্থনা ও আপ্যায়ন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি--এই আটটি খাতে নির্বাচিত আট জন প্রতিনিধি দায়িত্ব পালন করবেন। নির্বাচিত আট জন বসে একজনকে তাদের কেবিনেট প্রধান নির্বাচন করবেন এবং প্রতি শ্রেণি থেকে ২ জন করে তাদের সহযোগী মনোনীত করবেন। এক্ষেত্রে কেবিনেট মেম্বারের সংখ্যা দাঁড়াবে ১৮ জনে।

আর এসবই করা হচ্ছে শিশুদের মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা শেখানোর জন্য। প্রশ্ন হলো, ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য স্কুলে পড়াকালীন একজন শিক্ষার্থীকে কত ধরনের মূল্যবোধ শেখানো প্রয়োজন এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবস্থান সেখানে কততম? শিশুদেরকে সমাজের সকল নৈতিকতা, মূল্যবোধের চর্চা স্কুলগুলো শেখাতে পারছে কি না? আমাদের রাষ্ট্র স্কুলের শিক্ষকদের সেভাবে গড়ে তুলেছে কিনা? এসব দিক বিবেচনায় না নিয়ে স্কুল শিক্ষার্থীদেরকে শুধু গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ শেখাতে যদি চেষ্টা করা হয়, তবে সেখানে ভাল ফল নাও আসতে পারে, বরং ফল হতে পারে উল্টো। বিগত পাঁচ বছরের স্কুল কেবিনেট নির্বাচনকে ঘিরে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনায় আমরা এই উল্টো চিত্রই লক্ষ্য করেছি।

আমাদের শৈশব নব্বুই দশকের। তখনো স্কুলে শ্রেণি প্রতিনিধি নির্বাচিত হতো এবং শিক্ষকবৃন্দ এতে নেতৃত্ব দিতেন। ক্লাসের ভদ্র, উদ্যমী, সংগঠক, মেধাবীদের মধ্যে থেকে এক বা দুই জন ক্লাস ক্যাপ্টেন নির্বাচন করা হতো। শিক্ষকদের আয়ত্বাধীন ছিল ওই ক্লাস ক্যাপ্টেন। এখনকার স্টুডেন্টস কেবিনেট ম্যানুয়ালে যেগুলো বলা হয়েছে তার চেয়েও বেশি কিছু তখন শিখেছি আমরা। আর এখন বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, বেশির ভাগ নির্বাচিত কেবিনেট প্রতিনিধি শিক্ষকবৃন্দের অনুগত নয়; শিক্ষার্থীদের নিকট অনুকরণীয়, মাননীয় নয়; আদর্শের ধারক নয়; সব ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসহ স্কুলের অনেক কল্যাণ সাধন সম্ভব হয়নি এদের দ্বারা, বরং সমস্যা আরও বেড়েছে।

তো খুব স্বাভাবিকভাকেই জনমনে প্রশ্ন উঠেছে যে, কেবিনেট গঠন বা নির্বাচন কী ছাত্রদের জন্য আদৌ মঙ্গল বয়ে এনেছে? যদি এনেই থাকে তবে তা কতখানি, সেটা বিচার বিশ্লেষণ করা জরুরি। এবং স্টুডেন্ট কেবিনেটের সুফল-কুফল বিশ্লেষণ করে প্রক্রিয়াটি আদৌ জারি রাখা প্রয়োজন কিনা সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ অপরিহার্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমাদের নতুন সময়ে প্রকাশিত ; ১৮ এপ্রিল, ২০১৯