প্রচ্ছদে ব্যবহৃত চিত্র : মার্টিনি কা

বলা নেই কওয়া নেই রাত্রির দুই প্রহরে হঠাৎ আমার মেসে লাল্টুর আবির্ভাব! কিছু বুঝে ওঠার আগেই লাল লাল চোখে সমুদ্রের ঢেউ তুলে বলল, আমার সব শ্রম বৃথা গেল রে...। আমার সব শ্রম বৃথা গেল!
আমি চোখ কচলে ভালো করে লাল্টুর দিকে তাকাই। রাত্রির ঘড়িতে সময় তখন দেড়টা, আমি ঘুমাইনি যদিও তবুও পুরো ব্যাপরটাকে স্বপ্ন স্বপ্ন বিভ্রম মনে হওয়ায় আরেক দফা চোখ কচলে, শরীরে চিমটি কেটে নিশ্চিত হই—না, এটা কোনো ঘুমজনিত হ্যালুসিনেশন নয়; আমার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে বিলকুল লাল্টুই বটে। আমার বাল্যবন্ধু। আমার শৈশবসঙ্গী। একই গ্রামে বাড়ি আমাদের, যদিও একই স্কুলে পড়িনি। লাল্টু পড়ত মাদ্রাসায়। তবে স্কুল শেষে বাড়ি ফিরে বিকেলবেলা ঠিকই আমরা এক মাঠে খেলতাম। তাকে আমি আজন্ম চিনি। কিন্তু আজকে লাল্টুকে যেন চিনতে পারছি না। এ লাল্টু সেই চেরচেনা লাল্টু নয়।
আমি লাল্টুকে চেনার অভিপ্রায়ে ফের চোখ কচলাই। চিনতে পারি না। কেমন ঝাপসা ঝাপসা লাগে। বাইরে দাঁতকপাটি শীত আর কুয়াশার ধুম্রজাল। মনে হচ্ছে বাইরের সমস্ত কুয়াশা এসে ভর করেছে আমার চোখে।
লাল্টুকে হাত ধরে বিছানায় বসাতে সচেষ্ট হই। বিছানা মানে মেঝেয় পড়ে থাকা একখানা তোশক। তোশকের ওপর একফালি ময়লা অধোয়া চাদর ছিল বটে, দুদিন ধরে তারও হদিস নেই। কে জানে, বুয়া কেচে দেওয়ার উদ্দেশে নিয়ে গেছে কি না!
এই বিছানায় পশ্চাৎদেশ ছোঁয়াতে অস্বীকৃতি জানায় লাল্টু। বলে, চল, ছাদে গিয়ে বসি।
‘এই এত রাতে ছাদে? কী পরিমাণ শীত আর কুয়াশা পড়েছে, দেখেছিস?’ নারাজি প্রস্তাব বেরোয় আমার কণ্ঠ থেকে। কিন্তু লাল্টু মানতে নারাজ। ‘চল, চল, রাতের আকাশে নিজস্ব বিষাদ উড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে এক ধরনের সুখ আছে। আবদ্ধ ঘরে দুঃখ-কষ্ট বিনিময় করে কোনো সুখ নেই রে।’
সেই সুখ পেতে লাল্টুকে সঙ্গে নিয়ে অতঃপর ছাদে আসন লই। পৌষের রাত উত্তর থেকে হিমেল হাওয়া বয়ে এনে আমাদের হাড়ে কাঁপন ধরাতে চায়। চেয়ে ব্যর্থ হয়। ব্যর্থ না হয়ে পারে না, কেননা আমাদের দুজনের বুকের গভীরেই যে ততোধিক শীত। এ শীত প্রকৃতির শীতের কাছে বড়ই নস্যি। উত্তুরে হাওয়ার কি সাধ্য আছে এ শীতকে হার মানায়?
ফসসস করে সিগারেট জ্বালিয়ে লাল্টুই কথা শুরু করে—‘আজ নতুন অভিজ্ঞতা হলো, বুঝলি; ছেলেদের শরীরের কোনো দাম নেই। পাঁচ পয়সার দাম নেই।’
আমি মনে মনে বলি, বাজারে এখন পাঁচ পয়সা পাওয়াই যায় না, গাধা। আরেকটি সিগারেট জ্বালিয়ে ‘হুমম’ বলে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাই লাল্টুর দিকে। আকাশে চাঁদ নেই। চারপাশে কুয়াশার আবরণ। আমরা কেউ কারো মুখ দেখতে পাই না। শুধু ছায়া ছায়া অবয়ব অনুভব করি। উপরন্তু সিগারেটের ধোঁয়া এই কুয়াশার সঙ্গে মিলেমিশে পরিবেশটাকে কেমন রহস্যময় করে তুলেছে।
‘জানিস, মেয়েরা যেসব জায়গায় শরীর বিক্রির জন্য দাঁড়িয়ে থাকে সেসব জায়গায় আমিও দাঁড়িয়ে ছিলাম। চন্দ্রিমা উদ্যান, সংসদ ভবনের সামনে, ফার্মগেট ফুটওভার ব্রিজের নিচে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা পার্ক...। নাহ্! কোনো জায়গাতেই কাস্টমার পেলাম না। আমার চোখের সামনে মেয়েগুলো দেদারসে ভাড়া হয়ে যায়। কত কত খদ্দের ওদের!’
‘হুমম...। এ বড় বৈষম্য হে, এ বড় বৈষম্য!’ লাল্টুর আক্ষেপের আগুনে ঘি ঢালি আমি।
লাল্টুর কণ্ঠটা আবার ধুলোপড়া রেকর্ডের মতো ঘ্যার ঘ্যার করে বাজতে শুরু করে, এই যে এত জিম টিম করে সিক্স প্যাক বডি বানালাম, তাতে লাভটা কী হলো, বল? একটা খদ্দেরও জোগাড় করতে পারলাম না! আসলে মেয়েরা কি কোনো ছেলে খদ্দের খোঁজে?
কী জবাব হতে পারে এ প্রশ্নের। আমি তো কোনো মেয়ে নই। কিংবা এ ব্যাপার নিয়ে কখনো কোনো মেয়ের সঙ্গে তো আলাপও হয়নি আমার। তাহলে জানবো কী করে যে মেয়েরা কোনো ছেলে খদ্দের খোঁজে কি না? আমার খুব অসহায় বোধ হয়। চোখের সামনে বিপদগ্রস্ত কোনো মানুষকে সাহায্য করতে না পারার মতো কষ্ট অনুভব করি আমি। এ রকম কষ্ট অনুভব করেছিলাম কিশোরবেলায় একবার। ট্রেনের তলায় ঝাঁপ দিয়ে আমাদের চোখের সামনে এক লোক মারা যাচ্ছিল কিন্তু আমরা তাকে বাঁচানোর জন্য কিছুই করতে পারছিলাম না। কারণ, মানুষটা বারবার বলছিল, ‘হামাক কেউ ধরবিন না... ধরবিন না। ভগবানের কাছে যাওয়ার সময় কেউ হামার জাত মারবিন না। দয়া করেন তোমরা!’
আমরা সত্যিই খুব মহানুভবতা দেখিয়েছিলাম; মরার আগে হিন্দু বামুনের জাত মারিনি, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছিলাম, লোকটা কাটা মুরগির মতো ছটফট করতে করতে একসময় নিথর হয়ে গেল।
লাল্টুও ওই হিন্দু ব্রাহ্মণের মতো একদিন এক অদ্ভূত ভাবনায় ঝাঁপ দিয়ে বলেছিল, মেয়েরা যদি শরীর বিক্রিকে পেশা হিসেবে নিতে পারে তবে ছেলেরা কেন পারবে না?
আমরা ইয়ার্কি করতে করতে বলেছিলাম, ‘আলবৎ পারে। তা তুই তো হতে পারিস এ পেশার পথিকৃৎ উদ্যোক্তা।’
লাল্টু আমাদের ইয়ার্কিকে সিরিয়াসভাবে নিয়েছিল কি না কে জানে। আমরা দেখলাম লাল্টু হঠাৎ জিমে ভর্তি হয়েছে। সকাল-সন্ধ্যা ধানমন্ডি লেকে দৌড়াদৌড়ি করছে। আমাদের চোখের সামনে একটু একটু করে বদলে যেতে শুরু করল লাল্টুর শরীর। তারপর একদিন বাহু ফুলিয়ে আমাদের সামনে এসে বলল, দিস ইস কলড সিক্স প্যাক। ‘ওয়েলডান ম্যান’ বলে লাল্টুকে বাহবা দিলাম আমরা। শুধু তাই নয়, বন্ধুরা চাঁদা তুলে কড়াই গোশতে গিয়ে একটা পার্টিও দিলাম লাল্টুর ছয় প্যাক শরীরকে সেলিব্রেট করতে।
সেই সিক্স প্যাক বডি বিল্ডার লাল্টু এখন কুয়াশার অন্ধকারে বসে আমার সামনে ছোঁক ছোঁক করে কাঁদছে। ‘আমার সব পরিশ্রম বৃথা গেল রে... সব শ্রম বৃথা গেল...।’
আবার সিগারেট জ্বালাই। বিপন্ন বোধ করি। লাল্টুর জন্য কিছুই করতে পারছি না। এই সেই লাল্টু যাকে নয় বছর বয়সে দুনিয়ায় রেখে বাপটা মরে গেছে। মরার আগে মাকে বলে গেছে, ছোলডাক মানুষ করিস বউ।
ছেলেকে মানুষ করতে লাল্টুর মা সরিসৃপের মতো বুক দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত এক গ্রাম থেকে একদিন চলে আসে ঢাকায়। মোহাম্মদপুর এলাকার বাঁশবাড়ি বস্তিতে মাথা গোজার একটা ঠাঁই করে নেয়। ঠাঁইটা অবশ্য করে দেয় লাল্টুর একমাত্র দুলাভাই। দুলাভাইটা এই বস্তিতে থাকে আর এই শহরে রিকশা চালায়। শাশুড়ির বিস্তর অনুনয় বিনুনয়ে একদিন নিয়ে আসে ঢাকা শহরে এবং ব্যাচেলরদের একটা মেসে কাজ জুটিয়ে দেয় বুয়ার। বুয়াগিরি করে লাল্টুর মা প্রতি মাসে টাকা পাঠায় কাউয়াতলা হাফেজিয়া মাদ্রাসায়; কেননা সেখানে পড়ালেখা করছিল লাল্টু। লাল্টুকে পড়ালেখা শিখিয়ে মানুষ করতে হবে—এমনটাই স্বামীর মৃত্যুর সময় কথা দিয়েছিল লাল্টুর মা।
জামাই-শাশুড়ি এক বস্তিতে থাকে একথা জানে না বস্তিবাসী কেউ, জানে না কাউয়াতলাবাসীও। জানলে উভয়স্থলে ঢিঢি পড়ে যাবে, তাই তথ্যটুকু গোপন রাখে জামাই শাশুড়ি দুজনেই। শুধু জীবনের দায় মেটাতে প্রতি মাসে গ্রামে টাকা পাঠায় দুইটি প্রাণি। জামাই টাকা পাঠায় বউয়ের কাছে আর শাশুড়ি টাকা পাঠায় লাল্টুর কাছে। এভাবেই চলছিল জীবন।
লাল্টু হাফেজ হয়ে ওঠে একদিন। ‘মা, তুই ফির‌্যা আয়। আর কষ্ট করা লাগবে না। হামি এখন একটা কিছু কর‌্যা খাওয়া পারমো।’ বলে লাল্টু। লাল্টুর কথায় খুশির জল আসে মায়ের চোখে। ফিরে যায় গ্রামে। কিন্তু হাফেজিয়া বিদ্যা দিয়ে খুব বেশি কিছু করতে পারে না লাল্টু। বড়জোর মসজিদের ইমাম হওয়ার প্রস্তাব পায় কিংবা মসজিদে আজান দিতে বলে লোকজন। বিনিময়ে কোনো বেতন দিতে রাজি নয় মসজিদ কমিটি। ‘পরকালে পুরস্কার পাবিন, বাবা। আল্লাহ তোমার ভালো করবে।’ এ কথা বলে মাথার টুপিটা ঠিক করে দেয় লাল্টুর।
এভাবে জীবন চলতে পারে না, বুঝতে পারে লাল্টু। একদিন কাউয়াতলা ভোকেশনাল স্কুলের হেড মাস্টারের পায়ের ওপর আচমকা আছড়ে পড়ে সে। ‘হামাক ভর্তি কর‌্যা ল্যান স্যার। হামি ম্যাটিক পরীক্ষা দিবার চাই।’ লাল্টুর চোখের পানিতে ভিজে যায় হ্যাড স্যারের পা।
মন গলে যায় হেড স্যারের। ‘বাবারে, চাইলেই তো আর ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়া যায় না। ক্লাস নাইনে ভর্তি হও। রেজিস্ট্রেশন করো। দুই বছর পড়ালেখা করো। তারপর ম্যাট্রিক পরীক্ষা। বুঝছ?’
লাল্টু ভর্তি হয়ে যায় ভোকেশনাল স্কুলে। কিন্তু খরচ চালাবে কে? লাল্টুর মা আবার পাড়ি জমায় ঢাকায়। এসএসসি পাশ করার পর স্যাররা পরামর্শ দেয় লাল্টুকে এই কারিগরি কলেজেই ভর্তি হয়ে যেতে। ডিপ্লোমা পাশ করার পর চাকরি পাওয়া নাকি সহজ, লাল্টু তাই কারিগরি কলেজেই ভর্তি হয়ে যায়। মাকে বলে, ‘আর কয়েকটা দিন কষ্ট কর, মা। এই তো, পাশ কর‌্যা বার হলেই হামার চাকরি।’
কিন্তু পাশ করে বের হওয়ার আগেই আরেকটা বরশির আঁংটায় আটকা পড়ে লাল্টু। প্রেম, কুহক, মোহ অথবা মায়াজাল তার নাম। ঘোরগ্রস্ত কোনো এক অমাবশ্যার সন্ধ্যায় লাল্টু গিয়েছিল মেয়েটির সঙ্গে দেখা করতে। এবং মেয়েটির ঘরেই বটে। আর এই সুযোগে বাইরে থেকে ঘরের শিকল তুলে দিয়েছিল সচেতন পড়শিরা।
শালিস বসল অতঃপর। অল্পবয়সী এক বিধবার ঘরে কেন ভরসন্ধ্যায় প্রবেশ করবে এক উঠতি তরুণ? কী উদ্দেশ্য হে তোমার? তুমি না হুজুর? হাফেজিয়া মাদরাসায় পড়িছিন! দাড়িও রাখিছিন, মাশাল্লাহ!
লাল্টু কোনো উত্তর দিতে পারেনি। মাথা নিচু করে বসেছিল ঠায়।
এ বড় পাপ হে! এ বড় অন্যায়! বেগানা বিধবা নারীর সাথে লটরপটর! আল্লাহর আরশ কাঁপ্যা উঠপে। এখনই বিয়া দিয়া দ্যাও দুইডারে, এখনই। এই পাপের আর কোনো সমেধা নাই।
লাল্টু কেঁদেকেটে শুধু দুইটি দিন সময় চাইল সভাসদদের কাছে। বিয়ে করতে আপত্তি নেই তার। শুধু মায়ের কাছ থেকে একটু অনুমতি প্রার্থনা করতে চায় সে। মা যে থাকে সেই দূর দ্যাশে, ঢাকায়।
লাল্টুর কান্নায় যুক্তি আছে বটে, বিচারকরা বুঝলেন। তাকে দুদিন সময় দেয়া যেতেই পারে। কিন্তু তারা ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারলেন না দুদিন পর কি বিস্ময় অপেক্ষা করছে তাদের জন্য।
দুদিন নয়, ঘটনার পর দিনই কাউয়াতলাবাসীর সকাল হয় এক ভরপুর চমকের মধ্য দিয়ে। তারা সবিস্ময়ে আবিস্কার করে, লাল্টু আর ওই মেয়ে, পিয়ারা যার নাম, উধাও দুজনেই। কোথায় গেছে কেউ জানে না!
এই ঘটনার দু বছর পর লাল্টুর সঙ্গে আমার দেখা ঢাকায়, সিটি বাসে।
আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। হলে সিট পাইনি বলে মেসে থাকি। জিগাতলা থেকে সিটি বাসে চেপে শাহবাগে গিয়ে নামি। এ রকম সময়েই একদিন সিটি বাসে লাল্টুকে দেখি আমি। কি বিস্ময়! পাঞ্জাবিবীহিন লাল্টুকে চেনাই যায় না। মুখে দাড়ি নেই। টুপিও নেই মাথায়। প্যান্ট-শার্ট ইন করা ঝাঁ চকচকে ক্লিন শেভড লাল্টুকে দেখে মুখ হা হয়ে যায় আমার।
তুই লাল্টু না?
লাল্টু আমার মুখের দিকে তাকায়। এক মুহূর্ত পর ওর চোখ দুটো বারুদের মতো দপ করে জ্বলে ওঠে অনেক দিনের পুরনো মানুষকে চিনতে পেরে। বাসের মধ্যেই আমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে—কতো দিন পর...। কেমন আছিস তুই?
সেই থেকে আমাদের বন্ধুত্ব পুন:স্থাপিত হয়। আমরা মাঝে মাঝেই ধানমন্ডি লেকের ব্যাচেলর পয়েন্টে বসে থেকে বিকেলগুলো কাবার করতে থাকি। রকমারি গল্পগুজবে আমাদের দূরত্ব কমতে থাকে। এভাবে আমাদের বন্ধুত্ব আবার আগের মতো একটা বিশ্বাসযোগ্য অবস্থানে চলে এলে একদিন লাল্টু জানায়, সেই ঘটনার পর পিয়ারাকে সঙ্গে নিয়ে কাউয়াতলা থেকে পালিয়ে তার মা আর দুলাভাইয়ের কাছে চলে এসেছিল লাল্টু। কিন্তু মা আর দুলাভাই কেউ তাদের গ্রহণ করেনি। দুলাভাই হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কষে এক থাপ্পর মেরেছিল লাল্টুর কানসা বরাবর। আর মা মাছ কাটা বটি নিয়ে তেড়ে এসেছিল জবাই করতে। লাল্টু আর পিয়ারা কোনোমতে জান নিয়ে পালিয়ে গিয়ে চন্দ্রিমা উদ্যানে আশ্রয় নিয়েছিল সেদিন। হতবিহ্বল অবস্থায় কখন যে রাত নেমে এসেছিল বুঝতেই পারেনি মানুষ দুটি। এখন কোথায় যাবে, কী করবে এসব ভাবতে ভাবতে ভীষণ ভয় পেয়ে কান্না জুড়ে দিয়েছিল পিয়ারা বানু।
সর্বনাশটা ডেকে আনে এই কান্নাই। কোত্থেকে প্রু প্রু শব্দে বাঁশি বাজাতে বাজাতে তিন চারজন সিকিউরিটি গার্ড এসে ঘিরে ধরে ওদের।
‘ওই মাগি! কী হইছে তোর! কান্দস ক্যান?’
‘ওই! কী করছস তুই ওরে?’ লাল্টুকে সরাসরি প্রশ্ন করে একজন।
‘কিছু করি নাই, ভাই। কী করমো!’ তিনবার ঢোক গিলে কথাগুলো বলেছিল লাল্টু।
‘কিছু করস নাই, না? খানকির পোলা তোর মায়ের বাপ! ডান্ডা দিয়া হোগায় দুইডা বাড়ি দিলে ঠিকই সিধা হইয়া যাইবি।’
‘কান্দন থামা মাগি!’
লাল্টুর পেটে আরেকজন ডান্ডার গুতো দিয়ে বলে, ‘বাড়ি কই তোগো, হুম?’
বাড়ি... ঢোক গিলে লাল্টু। এই তো কাছেই। বলে আবার ঢোক গিলে।
‘কাছেই কই? নাম কইতে পারস না?’ খেঁকিয়ে ওঠে একজন।
ধমক খেয়ে লাল্টু পিয়ারা একসঙ্গে বলে ওঠে, কা...কাউয়াতলা, বাঁশবাড়ি।
‘কীরে! দুইজন দেহি দুইডা নাম কয়! কেস তো খারাপ।’ পরস্পরের দিকে মুখ চাওয়াচাউয়ি করে সিকিউরিটি দুজন।
এরপরের ঘটনা খুব দ্রুত ঘটে। দুইজন খাকিধারী লাল্টুকে প্রায় চ্যাংদোলা করে টেনে হিঁচড়ে উদ্যানের বাইরে রাস্তার কোণায় পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে যায়। আর বাকি দুইজন পিয়ারা বানুকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে উদ্যানের আরো ভেতরে জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে যায়। কি বুঝে তখন ঝোঁপজঙ্গলে লুকিয়ে থাকা ঝিঝি পোকারা তাদের করুণ সুরধ্বণির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। তাদের সম্মিলিত কোরাসের সঙ্গে বাঙ্গি তুলোর মতো উড়ে যেতে থাকে পিয়ারার কান্নার সুর।
ঢাকায় তখন ব্যাপক ধরপাকড় চলছিল। কার্পাস ভবনে জঙ্গি হামলার পর যাকে তাকে জঙ্গি সন্দেহে গ্রেপ্তার করছিল পুলিশ। না করে উপায় ছিল না, কারণ প্রত্যেক পুলিশকে দৈনিক গ্রেপ্তার টার্গেট বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। এ অবস্থায় লাল্টুকে পেয়ে পুলিশের মনে হলো, তাদের দুর্দশা দেখে আল্লাহ নিজ হাতে রহমত পাঠিয়েছে। আল্লাহর রহমত উপেক্ষা করা উচিত হবে না। তাই পরদিন সকালে লাল্টুকে জঙ্গি বলে সটান চালান করে দিয়েছিল কোর্টে।
ওদিকে পিয়ারার কি হয়েছিল কে জানে! কেবল একঝাঁক ঝিঝি পোকা, ঝোপজঙ্গল আর ছানিপড়া চোখের মতো ঘোলাটে একখণ্ড চাঁদ হয়ত জানে তার কিছুটা।
মাস তিনেক পর জেল থেকে বের হতে পেরেছিল লাল্টু। জেল থেকে বেরিয়েই সোজা চলে গিয়েছিল চন্দ্রিমা উদ্যানে। পুকুরের পানিতে হারিয়ে যাওয়া আংটি খোঁজার মতো করে তন্ন তন্ন করে খুঁজেছিল পিয়ারাকে। পায়নি। সেখান থেকে চোখ মুছতে মুছতে চলে গিয়েছিল বাঁশবাড়ি বস্তিতে। হায়! বস্তি কোথায়? সব যে বিরাণভূমি! আশপাশের লোকজনের কাছ থেকে লাল্টু জানতে পারে, আগুন লেগে সব শেষ হয়ে গেছে। আহারে! তার মা দুলাইভাই কি বেঁচে আছে, নাকি মরে গেছে? হয়ত বেঁচে আছে। হয়ত ফিরে গেছে কাউয়াতলায়। লাল্টু আর সেসব খোঁজ নিতে চায় না।
এরপর লাল্টু জীবন বেঁচে রাখার তাগিদে একটা আয়ুর্বেদিক কোম্পানিতে ওষুধ বিক্রির কাজ জুটিয়ে নেয়। তখনই তার মুখ থেকে দাড়ি উধাও হয়। শরীর থেকে নেমে যায় পাঞ্জাবি আর উঠে আসে শার্ট প্যান্ট।
কিন্তু কী মনে করে রোজ একবার করে রাতে চন্দ্রিমা উদ্যানে ঘুরতে যায় লাল্টু। এই নিয়মিত যাতায়াতের এক পর্যায়ে পরিচয় হয় পিংকি, ঝুমা, পাপিয়াদের সঙ্গে। ওরা জানায়, পিয়ারা নামে একজন ছিল বটে। মাস খানেক এখানেই ওদের মতো কাজ করেছিল। তারপর মনে হয় হাইকোর্টের ওই এলাকায় চইলা গ্যাছে। এদিকে আর আহে না।
লাল্টু বেশ কিছুদিন হাইকোর্ট এলাকাতেও ঘোরাঘুরি করেছে। সন্ধ্যা নেমে এলে রাস্তার ল্যামপোস্টের হলুদ আলোয় ভিজতে ভিজতে পিয়ারাকে খুঁজেছে। ফার্মগেট এলাকাতেও খুঁজেছে। মানিক মিয়া এভিনিউয়ের পুবদিকে খেজুর বাগানের আধোআলো অন্ধকারে গালে ঠোটে বাহারী রঙ মেখে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েগুলোর মাঝেও একটা মুক্তার দানার মতো ঘোলাটে রঙের মেয়েকে খুঁজেছে, যে মেয়েটা মাত্র একত্রিশ বছর বয়সেই বৈধব্য বরণ করেছিল। যার জন্য লাল্টুর মনে বিছুটির জ্বালা ওঠে এখনো!
তারপর লাল্টু একদিন সিদ্ধান্ত নেয় যে সেও পতিতাবৃত্তি করবে। মেয়েরা যদি পারে, সে কেন পারবে না? আমাদের কাছে পরামর্শ মাগলে আমরাও উৎসাহের সলতে উসকে দেই। লাল্টু আমাদের পরামর্শ মোতাবেক প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত অব্দি চন্দ্রিমা উদ্যান, ফার্মগেট ওভারব্রিজ, খেজুরবাগান ইত্যাদি এলাকায় দাঁড়িয়ে থাকতে শুরু করে। কিন্তু তার কাছে কোনো মহিলা খদ্দের আসে না। সে ভীষণ হতাশ হয়ে পড়লে আমরা ফের পরামর্শ দেই যে জিমে যেতে হবে। সিক্স প্যাক বডি বানাতে হবে। কেননা এ পেশায় শরীরই মূল বিনিয়োগ।
সেই মোতাবেক শরীর বানিয়েও কোনো লাভ হলো না। সেই সিক্স প্যাক লাল্টু এখন গনগনে শীতের রাতে ছাদের ওপর বসে কুয়াশায় স্নান করতে করতে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ওঠে। আমার সব শ্রম বৃথা গেলরে...।
ব্যাটা ছেলের কান্নার দৃশ্যের মতো এমন বাজে দৃশ্য আর হয় না। আমি ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার উদ্দেশে সিগারেটের প্যাকেট খুলে দেখি পুরোটাই ফাঁকা। কান্নারত লাল্টুর কাঁধে হাত রেখে ‘থাক, রুম থেকে সিগারেট আনি’ বলে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াই।