গত শতকের সত্তুর দশকে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ স্যামুয়েলসন বলেছিলেন, পৃথিবীতে আর কখনোই মন্দা আসবে না। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী জন মেজর ও অর্থমন্ত্রী নরম্যান্ট ল্যামন্টও বলেছিলেন, মন্দা হবে না। তাঁদের সঙ্গে তৎকালীন প্রায় সব অর্থনীতিবিদই সুর মিলিয়েছিলেন। তাঁদের যুক্তি ছিল খাদ্যে উদ্বৃত্তি। একই যুক্তি দিয়ে আমাদের একমাত্র নোবেলজয়ী (শান্তিতে) অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রায়সই বলেন, দারিদ্রকে জাদুঘরে পাঠানো হবে।
কিন্তু ইতিহাস এসব কথায় সায় দেয়নি। স্যামুয়েলসন, জন মেজর, ল্যামন্ট--সবার ভবিষ্যৎবাণীকে নাকচ করে দিয়ে ১৯৯০ সালেই বৃটেনে দেখা দিয়েছিল মন্দা। ব্রিটিশ সাংবাদিক ও অর্থনীতিবিদ ক্রিস হারম্যানের ইকোনোমিক্স অব দ্য ম্যাডহাউজ বই থেকে জানা যাচ্ছে, তখন বৃটেনের অর্থনীতি প্রতিবছর কমপক্ষে ৬ শতাংশ কম উৎপাদন করেছে। টানা তিন বছর ধরে চলমান মন্দায় প্রতি বছর ৩৬ বিলিয়ন পাউন্ডের উৎপাদন ক্ষতি হয়েছে। অপরদিকে জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, ৯০ দশকের অর্থনৈতিক মন্দার কারণে সারা বিশ্বে অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছিল ২ কোটি ৮০ লাখ। তখন পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের দেশগুলোতে দারিদ্রের হার তিনগুণ বেড়ে যায় এবং তার ফলে ১০ কোটি মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে চলে যায়। পূর্ব এশিয়ায় ১৯৯৭-১৯৯৯ মন্দার কারণে ১০ লাখ থাইল্যান্ডের অধিবাসী ও ২ কোটি ১০ লাখ ইন্দোনেশিয়ার অধিবাসী দরিদ্র জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছিল। (সূত্র: Walden Bello. Dilemmas of Domination, New York, 2005)।
এইসব প্রসঙ্গ উত্থাপনের নেপথ্য কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশে চলমান বিপর্যয়কার বন্যা। ইতিমধ্যে ২৮টি জেলা পানির নীচে তালিয়ে গেছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতিতে মঙ্গা দেখা দেবে কি না, দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে কিনা, হাজার হাজার মানুষ কর্মসংস্থান হারাবে কি না--এইসব সেই প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়। কারণ বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, মহামারী ইত্যাদি কারণে আফ্রিকার দেশগুলোতে দুর্ভিক্ষ, খাদ্য সংকট ও অর্থনৈতিক মন্দা লেগেই আছে বলা যায়।
আবার পুঁজিবাজার ধ্বস কিংবা যুদ্ধের কারণেও মন্দা দেখা দিতে পারে। ১৮১৫ সালে যেমনটি ঘটেছিল ইউরোপে। ওই সময় নেপোলনীয় যুদ্ধের পর বৃটেনের অর্থনীতি ধ্বসে পড়েছিল। এতোটা অতীতে যেতে না চাইলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের শাসনামল বিশ্লেষণ করলেই তা বোধগম্য হবে। ওই সময় ইরাক ও আফগানিস্তানে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল মার্কিন প্রশাসন। এরপর বুশ যখন ক্ষমতা হস্তান্তর করেন ওবামার কাছে ২০০৯ সালে, তখন যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের হার ছিল ৭ শতাংশ এবং ৮০’র দশকের মন্দার পর আমেরিকায় সেবারই সবচেয়ে বেশি মানুষ চাকরি হারায়।
বন্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মানবিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ইতিহাস এ দেশে নতুন নয়। বাংলাদেশে স্মরণকালের ইতিহাসে বড় বন্যাগুলো হয়েছিল ১৯৭৪, ১৯৭৭, ১৯৮০, ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৪ ও ২০০৭ সালে। এর মধ্যে ১৯৯৮ সালের বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল সবচেয়ে বেশি। এই বন্যায় দেশের ৬৩ শতাংশ অঞ্চল ডুবে গিয়েছিল (’৮৮ সালের বন্যায় প্লাবিত হয়েছিল ৬০ শতাংশ)। অনেক মানুষ পানিবন্দী হয়ে মারা যায়। খাদ্যের অভাব ও নানারকম রোগেও বহু মানুষ প্রাণ হারায়। ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় থেকে সৃষ্ট বন্যা সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্যোগ। এই বন্যায় উপকূলীয় অঞ্চলসহ প্রায় সারাদেশই ব্যাপকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ২০১৩ সালে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের কিছু জেলায় মৌসুমী বন্যা দেখা দেয়। এতে কয়েক লক্ষ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ে।
চলমান বন্যাতেও ইতিমধ্যে ৪০ লাখের ওপর মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। উত্তরাঞ্চলের সমাজকর্মী নাহিদ হাসান তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে মানুষকে আশ্রয়ের খোঁজে বউ বাচ্চা, বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে ছুঁটতে ভিডিওতে দেখছি। কয়দিন আগে চরের লোক কাইমে এসেছিল, আজ শত শত লোককে পুঁটলি নিয়ে চরে যেতে দেখলাম। কেউ কেউ উলিপুর-কুড়িগ্রামের দিকে ছুঁটছেন। আমি এক বুক পানি ভেঙে বাঁধের সড়কে উঠে, তারপর রমনা বাঁধের মোড় থেকে বউসহ ২ ও ৮ বছর বয়সি দুটো শিশুকে নিয়ে আপন উদ্যোগের মোড় থেকে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তায় এক কোমড় পানি ভেঙে ৫ ঘন্টা পর কুড়িগ্রামে পৌঁছুলাম। সবাই ছুটছে। মানুষ সেই এক কোমড় পানিতে দাঁড়িয়ে ভাত খাচ্ছে। পানি নাই, খাবার রান্নার সুযোগ নাই, বিদ্যুৎ নাই, মোবাইল নেটওয়ার্ক নাই। যুদ্ধাবস্থা! আমি স্রেফ পালিয়ে এলাম। এসে মোবাইলে চার্জ দিয়ে আপনাদের পরিস্থিতি অবগত করলাম। মানুষের দুর্ভোগ প্রকাশের ভাষা আমার নাই। আমি অসুস্থ, আমি ট্রমায়...।’
দেশের মানুষ যে এইরূপ ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে, সেই বিপর্যয় কী আখেরে মন্দা ও দুর্ভিক্ষ ডেকে আনবে যেমনটা এনেছিল নব্বুই দশকে ইউরোপে? আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই সময় থাকইে সতর্ক হওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রীয় কর্তারা পরিস্থিতি আঁচ করতে পারছেন বলে মনে হয় না। গণমাধ্যমের খবর বলছে, কোনো মন্ত্রীকে বন্যাকবলিত এলাকায় যেতে দেখা যায়নি। (সূত্র: বিডি নিউজ)। এই খবর সত্যিই উদ্বেগ ও আতঙ্কের। যাঁরা নিজেদেরকে ‘জনপ্রতিনিধি’ হিসেবে পরিচয় দেন তাঁরা যদি জনগণের দুর্দশায় পাশে না থাকেন তবে তাঁদের জনপ্রতিনিধি পরিচয়টিই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।
আমাদের অর্থনীতিতে প্রকাশিত ; ২২ জুলাই ২০১৯

0 Comments
Post a Comment