বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কিংবা শিক্ষার্থীদের কল্যাণার্থে ক্যাম্পাসে আন্দোলন করার বিষয়টি যখন প্রায় সোনালী অতীতে পরিণত হয়েছে, ঠিক তখনই বুয়েটের শিক্ষার্থীরা সেই প্রায় হারিয়ে যাওয়া আন্দোলনকে আবার ফিরিয়ে আনলেন। খবরে প্রকাশ, গত কয়েকদিন ধরে বুয়েটের শিক্ষার্থীরা ১৬ দফা দাবি নিয়ে আন্দোলন করছেন। তাঁদের দাবির মধ্যে রয়েছে গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানো, নিয়মিত শিক্ষক মূল্যায়ন কর্মসূচি চালু করা, বুয়েটের যাবতীয় লেনদেনকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে নিয়ে আসা, অফিসিয়াল মেইল আইডি প্রদান করা, পরীক্ষার খাতায় রোলের বদলে কোড ব্যবহার করা, নির্বিচারে ক্যাম্পাসের গাছ কাটা বন্ধ করা, বুয়েটের ওয়াইফাই সুবিধার আধুনিকায়ন করা, ইত্যাদি।
 
প্রত্যেকটি দাবিই যৌক্তিক। মাঝে একটি প্রজন্ম চলে গেছে যারা এসব দাবি নিয়ে ভাবেইনি। তারা এসেছে, গেছে, ক্লাস করেছে, পরীক্ষা দিয়েছে এবং সবশেষে সার্টিফিকেট নিয়ে বেরিয়ে গেছে। আশার কথা, এই প্রজন্ম আজব ঘুম থেকে জেগে উঠেছে এবং নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়েছে। নিজের বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজের প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভাবতে শিখেছে এবং নিজের প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন-অগ্রগতিতে অবদান রাখা কর্তব্য--সেই উপলব্ধির জন্ম হয়েছে। তাই তারা আন্দোলনে নেমেছে।
 
কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, এসব দাবি-দাওয়া নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নামার মোটেও কথা ছিল না। দাবিগুলো এতটাই মৌলিক ও যৌক্তিক যে সেগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবেই পূরণ হওয়ার কথা। কিন্তু তা হয়নি। একদিন, দুইদিন নয়; দিনের পর দিন, বছরের পর বছর তা হয়নি। আর হয়নি বলেই শিক্ষার্থীদেরকে আন্দোলনে নামতে হয়েছে। এটি রাষ্ট্রের জন্য, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের জন্য ভীষণ লজ্জার।
 
অশঙ্কা করা হচ্ছে, আন্দোলটি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও ছড়িয়ে পড়বে হয়ত। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রুয়েট, কুয়েট, চুয়েট, মেডিকেল কলেজগুলোসহ প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়রেই একই অবস্থা। এইসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যদি যৌক্তিক দাবি নিয়ে আন্দোলনে নামে তবে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
 
এই আন্দোলন করা শিক্ষার্থীদের মধ্যেই কেউ কেউ হয়ত একদিন ইউরোপ আমেরিকার বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাবেন, কেউ কেউ গুগল, মাইক্রোসফট, ফেসবুকে চাকরি করতে যাবেন, তখন অবার এই প্রতিষ্ঠানগুলোই নিজেদের কৃতীত্ব জাহির করার জন্য উঠেপড়ে লাগবে। লতায় পাতায় সম্পর্ক খুঁজে বের করে বলবে, হুমম, অমুক তো আমাদের বুয়েটের স্টুডেন্ট ছিল! তমুক তো আমাদের ঢাবির স্টুডেন্ট ছিল! ফেসবুক টুইটারে অভিনন্দনের বন্যায় ভাসিয়ে দিতে দিতে বেমালুম ভুলে যাবে যে, ওই শিক্ষার্থীদের সাফল্যের পথকে মসৃন করার বদলে একদা তারা বাধা সৃষ্টি করেছিল। তাদেরকে আন্দোলনে নামতে বাধ্য করেছিল।
 
কি নির্লজ্জ হিপোক্রেসি! কি মিথ্যে আত্মতুষ্টি!
 
আমাদের এই মিথ্যে আত্মতুষ্টির আরেক আশ্চর্য উদাহরণ হচ্ছে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড, প্রাচ্যের হার্ভার্ড, প্রাচ্যের কেমব্রিজ ইত্যাদি উপমা। আমরা একবারও ভেবে দেখি না, কী সাদৃশ্য হেতু এমন উপমা প্রয়োগ করছি? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক শিক্ষার্থী সাইফ তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কোনো শিক্ষার্থীসংগঠন কি আছে যাদের সদস্যদের গড় বয়স চল্লিশ বছর? সেখানে এমন কোনো শিক্ষকসংগঠন কি আছে যারা আগে থেকেই নির্ধারণ করে রাখে যে চার বছর পর কোন শিক্ষার্থীকে শিক্ষক বানাবে? হার্ভার্ডের ছাত্রনেতারা কী ধোপদুরস্ত জামা গায়ে দিয়ে ধান কাটতে কৃষকের মাঠে নেমে যায়? কেমব্রিজে শিক্ষার্থীদেরকে ভদ্রতা শেখায় কী তাদের গেস্টরুমের হর্তাকর্তারা? এমআইটির প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা কি গর্দভপালের মতো ক্যাম্পাসে হেঁটে যাওয়ার সময় যাকে দেখে তাকেই হাত পিছমোড়া দিয়ে স্লামালিকুম স্লামালিকুম বলে? অক্সফোর্ডে কি প্রশ্ন ফাঁস হয়? সেখানে কি রেজিস্টার ভবনে জমিদারি প্রথা চলে? অক্সফোর্ড কি তথ্য উপাত্তজনিত সমস্যার কারণে র‌্যাংকিং থেকে দিন দিন পিছিয়ে পড়ে?’
 
এসব প্রশ্নের উত্তর যদি না হয়, তাহলে কীসের ভিত্তিতে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলি? মীজান স্যার (জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মীজানুর রহমান) অবশ্য এক আড্ডায় হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘কার্জন হলের গম্বুজের সঙ্গে অক্সফোর্ডের গম্বুজের মিল রয়েছে।’