![]() |
আড়ংয়ের বিজ্ঞাপন। ছবি : সংগৃহীত |
তামারা আবেদের এক বছর আগের এক সাক্ষাৎকার ফেসবুকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেখানে ব্র্যাকের এই জ্যেষ্ঠ পরিচালক অনেক কথাই বলেছেন। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে যে দুটো কথা নিয়ে তা হচ্ছে—এক. আড়ংয়ের মুনাফা ব্যয় হয় দরিদ্র মানুষের কল্যাণে এবং দুই. আড়ং গ্রামীণ নারীদের অবসর কেনে, ব্যস্ত সময় কেনে না।
তামারার প্রথম কথার যুক্তি বোঝার জন্য এই সময়ের খ্যাতিমান দার্শনিক স্লাভো জিজেকের দারস্থ হওয়া যেতে পারে। জিজেকে বলেছেন, এটা হচ্ছে ভোগবাদের অপরাধবোধ কমানোর যুক্তি। এক্ষেত্রে তিনি স্টারবাকসের উদাহরণ টেনেছেন। বলেছেন, ‘স্টারবাকসের কফি অন্যদের চাইতে মাত্রাতিরিক্ত দামী এবং এই বেশি দাম রাখার পেছনে স্টারবাকসের যুক্তি হচ্ছে, এই কফির পাঁচ সেন্ট যায় গুয়েতেমালার কল্যাণে, দুই সেন্ট আফ্রিকার অন্য জায়গায়, এক সেন্ট বনভূমি বাঁচাতে ইত্যাদি ইত্যাদি। স্টারবাকস এসব বলে মূলত ভোক্তার অপরাধবোধ কমানোর জন্য।’
একজন ভোক্তা যখন অতি উচ্চমূল্যে এক মগ কফি পান করে তখন তার মধ্যে এই অপরাধবোধ কাজ করতে পারে যে, আহারে! এই দুনিয়াই কত মানুষ একমুঠো ভাতের অভাবে মারা যাচ্ছে, সেখানে আমি কিনা শুধু কফির পেছনে এত টাকা ব্যয় করছি!
এ ধরনের অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পাবার জন্য আগে ভোক্তারা বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দান করত বা গরীব দুঃখী অসহায় মানুষদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করার তাগিদ অনুভব করত। এখন স্টারবাকস কিংবা আড়ংয়ের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরাই বলছে, ভাই ভোক্তা, তোমার অপরাধবোধে ভোগার কোনো কারণ নেই। তোমার হয়ে আমরাই গরীব দুঃখীদের সেবা করব। তুমি শুধু বেশি দাম দিয়ে আমাদের পণ্য খরিদ করো! জিজেক এই যুক্তির নাম দিয়েছেন ‘আল্টিমেট ফর্ম অব কনজিউমারিজম’।
তাই আড়ং থেকে আপনি যখন দেড় লাখ টাকায় জামদানি কেনেন তখন আপনি শুধু কাপড়ই কেনেন না, পাশাপাশি আপনি অভাবী মানুষের কল্যাণ করেন, দরিদ্র নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেন। ফলে আপনার ভোগটা তখন আর ভোগ থাকে না। আপনার মনে তখন প্রশান্তি আসে এই ভেবে যে আপনি আসলে দানই করছেন এবং দরিদ্র নারীদের বেতন দিচ্ছেন। সেজন্য তামারা আবেদ বলেন, ‘আমরা যদি একেবারে সস্তায় পণ্য বিক্রি করি, তাহলে কারুশিল্পী, হস্তশিল্পীদের ন্যায্য মজুরি কীভাবে দেব?’
এখানেই প্রশ্ন—আড়ং কী তার কারিগরদের কিংবা কর্মীদের নায্য মজুরি দেয়? উত্তর হচ্ছে, দেয় না। এ নিয়ে জাতীয় দৈনিকে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে। এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই কম মজুরি প্রদানের পেছনে যুক্তি হিসেবে তামারা বলতে চাইছেন যে, তারা শ্রমিকদের অবসর কেনে, ব্যস্ত সময় কেনে না। অর্থাৎ মানুষের অবসরের দাম কম!
তামারার এই যুক্তি মেনে নিলে পৃথিবীর তাবৎ শ্রম আইন বাতিল হয়ে যায়। কারণ আন্তর্জাতিক শ্রম আইনের মূল ভিত্তিই হচ্ছে মানুষের অবসরের অধিকার। দুনিয়াজুড়ে শ্রমিক শ্রেণি রক্ত দিয়েছে এই অবসরের অধিকারের জন্য। অবসর সময়টুকুই মানুষকে মানুষ বানায়। অবসরে কাজ করার জন্য তাই বাড়তি যে মজুরি দিতে হয়, তার হার স্বাভাবিক কর্মঘন্টার চাইতে সচরাচর বেশি হয়। অথচ আড়ং সেই অবসর সস্তামূল্যে কিনে নিচ্ছে এবং জোর গলায় তা প্রচারও করছে। এরচেয়ে নির্লজ্জ ধৃষ্টতা আর কী হতে পারে!
দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে তাকালে আমরা দেখতে পাই যে অনেক শিল্পোন্নত দেশেও মালিকরা কোনো কোনো খাতে অবসর কিনছেন। তবে তা রাখঢাক করে কিনছেন। ক্ষেত্রবিশেষে অবসর চুরি করছেন। অভিবাসী শ্রমিক বা ছাত্রদের শ্রম তারা অবৈধভাবে কিনে নিচ্ছেন। কিন্তু সস্তা শ্রম পাবার জন্য নিজ দেশের মানুষের অবসর কেনাকে মহিমান্বিত করার এই যুক্তি সম্ভবত পৃথিবীবাসী এই প্রথম অবলোকন করল!
দরিদ্র মানুষের কল্যাণ করার সত্যিই যদি সদিচ্ছা থেকে থাকে আড়ংয়ের তবে তার উচিত আড়ংয়ের পঁচাত্তর হাজার কর্মীর কল্যাণ করা। কারণ তারাই সবচেয়ে দরিদ্র অবস্থায় আছে। একজন মানুষ কতটা দরিদ্র অবস্থায় থাকলে নিজের অবসরটুকুও বিক্রি করে দেয় তা সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায়—এজন্য মাইক্রো ইকোনমিক্সের গবেষক হতে হয় না।
সুতরাং এখন থেকে আড়ং যদি তার কারিগরদের নায্য মজুরি দেয় এবং কর্মীদের বেতন বৃদ্ধি করে তাহলেই মানুষ বুঝবে যে তারা সত্যিকার অর্থেই দরিদ্র মানুষের কল্যাণ করতে আগ্রহী। নচেৎ তামারা আবেদের আবেগী বক্তব্য কেবল বাগাড়ম্বর বলেই বিবেচিত হবে।
আমাদের নতুন সময়ে প্রকাশিত ; ১০ জুন ২০১৯
আমাদের নতুন সময়ে প্রকাশিত ; ১০ জুন ২০১৯
0 Comments
Post a Comment