কোনো একটা তত্ত্ব যখন প্রায়োগিক নিয়েমে পরিণত হয় তখন সেই তত্ত্বের তত্ত্বাবধানকারীদের আর খুব একটা বুদ্ধিমান না থাকলেও চলে। তাদের তখন কোনো চিন্তা-ভাবনা করারই প্রয়োজন পড়ে না প্রায়। অর্থাৎ তাদের থিউরি বা তত্ত্বটা তখন অনেকটাই অটো কামান্ড অনুযায়ী চলে। ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং!
পৃথিবীতে গণতন্ত্র এসেছে তা প্রায় দেড় শ দু’শো বছর হয়ে গেছে। এখন এই গণতন্ত্র খুব একটা বুদ্ধিমান মানুষ জন্ম দিতে পারছে না! বিশেষতঃ সাবেকি গণতন্ত্র তার মেধাচ্ছটা উত্তরসূরীদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে পুরোটাই ব্যর্থ হয়েছে, বলা যায়। পৃথিবীর এই প্রান্তে, মানে ভারত-বাংলাদেশে তো তার অবস্থা আরও গুরুচরণ! এই অঞ্চলের উদার গণতন্ত্রের তল্পিবাহকরা তাই প্রতিনিয়ত কথায় ও কাজে তাদের জৈবসারযুক্ত মেধার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন।
সম্প্রতি দেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি যদি সুস্থ থাকতেন তাহলে নিজেই গিয়ে কৃষকের জমির ধান কেটে দিতেন। এই বক্তব্যে দেখলাম অনেকেই হা হা হি হি করছেন, অনেকেই নাখোশ হয়েছেন, অনেককেই দেখলাম গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছেন! ছাত্রলীগ যখন বুকে নৌকার ছাপমারা গেঞ্জি পরিধান করে, এক হাতে ধানের শীষ আরেক হাতে
কাস্তে নিয়ে, কোমরে গামছা বেঁধে এবং মাথায় মাথাল সেঁটে ধান কাটতে নামল তখনও মানুষ এমন আচরণ করেছ। এমনকি পুলিশ যখন কৃষকের ধান কাটতে গেছে তখনও আহম্মক আমজনতা হাহা হিহি করতে কসুর করেনি।
এত হাহা হিহি করার তো কিছু নাই। অতিদুঃখে অশ্রুপাত করারও কিছু নাই। এইসব বক্তব্য ও কাজকর্মের অন্তরালে দুটো ইঙ্গিত অন্তত স্পষ্ট। এক. বাংলার দুঃখী কৃষক, তোমাদের দুর্দশায় আমরা সমব্যথী, তাই রোদে পুড়ে, জীবন বিপন্ন করে তোমাদের উদ্ধার করতে নেমেছি; আমরা আসলে তোমাদেরই লোক। দুই. ওরা (বিএনপি-জামায়াতসহ অপরাপর) তোমাদের লোক নয়, ওরা অভিজাত-ফিউডাল, জনতার কাতারের লোক না, তাই তোমাদের দুর্দশায় তাদের পুচ্ছটি নড়ে না!
বলা হয়ে থাকে, একটি সংস্কৃতি টিকে থাকে তার পুণঃসংস্কারের ওপর। ইংরেজিতে যাকে বলে কালচারাল রিপ্রোডাকশন। যদি কোনো কালচারের রিপ্রোডাশন না হয় তবে তার আয়ু বড়জোর দেড়শ বছর। এভাবেই সংস্কারের অভাবে হারিয়ে গেছে বহু আদিবাসী সংস্কৃতি, ভাষা, আচরণ ইত্যাদি। সংস্কৃত ভাষার কথাই ভাবা যাক। একসময়ের
মহাজনপ্রিয় এই ভাষাও হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে অরও কত কিছু! মহাকবি মাইকেল মধুসূদনের জীবনী থেকে জানা যায়, শৈশবে যশোরে তাঁদের বাড়ির কাছে এক মসজিদে ফার্সি ভাষা শিখেছিলেন তিনি। কারণ ফার্সি তখন ভারতের রাজভাষা। সে যাইহোক, এখনকার দিনে কোনো মসজিদে অন্য ধর্মাবলম্বীর প্রবেশিধার আছে কি? সেই
সংস্কৃতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
সংস্কৃতি টিকে থাকার আরেক কারণ হচ্ছে, সমাজের সঙ্গে সিঙ্ক করে চলা। যেসব সংস্কৃতি সমাজের সঙ্গে তালমিলিয়ে চলতে পারেনি, কালচারাল রিপ্রোডাকশন করতে পারেনি, তারাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
রাজনীতিও একধরনের সংস্কৃতি। সুতরাং এখানেও কালচারাল রিপ্রোডাকশন দরকারী, মূলত তার টিকে থাকার স্বার্থেই। ফলে বর্তমানের ছবি ও বক্তব্যকে সেই নিরিখে বিবেচনা করা যেতে পারে।
0 Comments
Post a Comment