পোড়ার দেশে প্রাণ জিয়ে না যেন কিছুতেই। হয় আপনি গাড়ি চাপায় মরবেন, নয় তো আগুনে পুড়ে মরবেন। রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছেন, উপর থেকে মস্ত ফুটের টব পড়ে মাথা ফাটিয়ে প্রাণটা নিয়ে যাবে আপনার। কিংবা মুহুর্মুহু বজ্রপাতে অঙ্গার হয়ে পড়ে থাকবেন বিদ্যুতের খুঁটির তলায়। এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরেক নতুন আপদ--গাছ চাপায় মৃত্যু।
গত সাত দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে গাছ চাপায় অন্তত পাঁচজন মানুষ মারা যাওয়ার খবর এসেছে গণমাধ্যমে। এদের মধ্যে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এক নারী, বরিশালের উজিরপুরে এক শ্রমিক, ভোলার লালমোহনে এক ব্যক্তি, সরিষাবাড়িতে এক মহিলা, পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় এক নির্মাণ শ্রমিক ও কুমিল্লার বুড়িচংয়ে এক নারী রয়েছেন।
ক্যালেন্ডারে এখন মধ্য চৈত্র হলেও প্রকৃতিতে বৈশাখের তাণ্ডব প্রায় প্রতিদিনই দেখা যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, বৈশাখ পড়লে কালবৈশাখীর তাণ্ডবলীলা আরো বাড়বে এবং হতাহতের সংখ্যাও বাড়বে। বিশেষ করে গাছ চাপায় মৃত্যু বিগত কয়েক বছর ধরে যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। এ প্রবণতা রাজধানীতেই বেশি লক্ষণীয়। ২০১৬ সালে গাছ চাপায় মারা গেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত খ্যাতিমান নির্মাতা খালিদ মাহমুদ মিঠু। রাজধানীর ধানমন্ডিতে আকস্মিকভাবে সড়কের পাশের মোটা একটি কৃষ্ণচূড়া গাছ ভেঙে পড়ে তার ওপর। গত বছরও ধানমন্ডিতে গাছের চাপায় মারা গেছেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান। এর আগে ২০১৭ সালের ১৯ মার্চ গাছের নিচে চাপা পড়ে মারা যান মুজাহিদুল ইসলাম নামে এক মোটরসাইকেল আরোহী। কয়েক বছর আগে গাছ ভেঙে রামপুরা, হাতিরঝিল, মিন্টু রোডের মন্ত্রিপাড়া, ধানমন্ডি, গুলিস্তানের মহানগর নাট্যমঞ্চ এলাকা ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গাছ উপড়ে পিকআপের উপর পড়ে দু’জন আহত হওয়ার ঘটনাও গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছিলো।
এ বছর চৈত্র মাস শুরু হওয়ার পর থেকেই প্রতিদিন নিয়ম করে দিনে-রাতে ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। মানুষের হতাহতের খবরও আসছে নিয়মিত। বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটছে খোদ রাজধানীতেই। কারণও আছে। বাংলাদেশের রাজধানীর বিশ্বের অন্যতম জনবহুল এক শহর। প্রায় দুই কোটি মানুষের বাস এই শহরে। কাজের প্রয়োজনে দিন-রাতের একটা বড় সময় রাস্তাঘাটে চলাচল করতে হয় এই মানুষগুলোকে। চলতে ফিরতে হঠাৎই ঝড়ের কবলে পড়ছেন তারা। আগে ঝড়বৃষ্টির সময় বড় বড় গাছের নিচেই আশ্রয় নিত মানুষ। এখন সেই আশ্রয়দাতা গাছগুলোই উড়তে পড়ছে মানুষের ওপর। কারণ কী? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিতভাবে বৃক্ষরোপণ, পরিচর্যার অভাব, মাটির গুণাগুণ পরীক্ষা না করা এবং দেখভালের জন্য সরকারি উদ্যোগ না থাকায় দমকা বাতাস হলেই গাছ উপড়ে পড়ার মতো ঘটনা ঘটছে। উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা বারবার বলছেন, বৃক্ষরোপণের সময় খেয়াল রাখতে হবে কী ধরনের গাছ এবং কোথায় রোপণ করা হচ্ছে। মাটির গুণাগুণ বিবেচনা করে জায়গাটিতে গাছটি ভারসাম্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে কিনা সেটিও বিবেচনায় আনতে হবে। আমাদের নগরের রাস্তাগুলোর আইল্যান্ডে মাটি কম, সেখানে গাছের শেকড় গভীরে যেতে পারে না। তাই সেখানে যদি বড় প্রজাতির গাছ লাগানো হয় তাহলে হালকা বাতাসেই তা উপড়ে পড়বে। আবার যদি লালমাটি হয়, সেখানে গাছ শক্তি পায় না। সামান্য বৃষ্টিতে মাটি খুব নরম হয়ে পড়ে, তখন ডালপালাও শক্তি হারায়, বাতাসে ভেঙে পড়ে। এজন্য মাটি পরীক্ষা করে উপযুক্ত স্থানে উপযুক্ত গাছ লাগানো উচিত।
রাজধানীতে খোলা জায়গার বড্ড অভাব। শুধু ভবনের পর ভবন উঠছে। ফাঁকা জায়গা নেই। তাই ঝড় শুরু হলে খোলা জায়গা না থাকায় সামান্য ফাঁকা জায়গা দিয়েই তীব্র গতিতে বাতাস বয়ে যায়। তখন গাছগুলো দুমড়ে-মুচড়ে পড়ে। এমনিতেই রাজধানীতে গাছের সংখ্যা কম। একটি শহরের মোট আয়তনের সাপেক্ষে যে পরিমাণ বৃক্ষরাজি থাকার কথা তার সিকি ভাগও নেই এ শহরে। স্বল্প সংখ্যক যে কয়েকটি আছে সেগুলোও ঝড়ে উপড়ে পড়ছে। কারণ গাছ রোপনের পর এর তেমন কোনো পরিচর্যা করা হয় না। গাছের অতিরিক্ত ডালপালা কাটা হয় না, ফলে গাছের মূল থেকে মাথা পর্যন্ত অনেক ভারি হয়ে পড়ে। যে কারণে অনেক সময় এমনিতেই গাছ হেলে পড়ে। এ রকম হেলে পড়া কিছু গাছ দেখা যাচ্ছে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, আজিমপুর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, সংসদ ভবন এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে।
খিলগাঁও নিবাসী এক ভদ্রলোক ফেসবুকে একটি গাছের ছবি পোস্ট করে লিখেছেন : ‘খিলগাঁও রেলগেট সংলগ্ন জোড়পুকুর মাঠের সামনে ৮০ ফুটের চওড়া রাস্তার ফুটপাথের পাশে বেশ কয়েকটি বর্ষীয়সী গাছ রয়েছে। যার মধ্যে একটি গাছ বয়সের ভারে অনেক বেশি নুয়ে পড়েছে। গাছটির বড় বড় ডালপালা রাস্তার উপর দিয়ে ছড়িয়ে আছে। স্বাভাবিকভাবেই এর নিচ দিয়ে চলাচলকারী যানবাহনের দুর্ঘটনার ঝুঁকি রয়েই যাচ্ছে। বিশালাকৃতির এই গাছটিকে পাশের একটি বৈদ্যুতিক পিলারের সঙ্গে নামেমাত্র তার দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। গাছের ওজনের চাপে ওই বৈদ্যুতিক পিলারটির অবস্থাও এখন বেহাল। অল্প বাতাসে যেকোনো সময় বাঁধা তার ছিঁড়ে যেতে পারে। তাতে রাস্তায় উপড়ে পড়তে পারে গাছটি, এমনকি পিলারটিও। এতে প্রাণহানিও ঘটতে পারে। কারণ প্রতিদিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষ গাছটির নিচ দিয়ে যাতায়াত করছে। যাতায়াতকারীদের মধ্যে রয়েছে স্কুলগামী কোমলমতি শিশুরাও।
এসব আসলে দেখবে কে? নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, গাছ লাগানো এবং বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি পুরনো গাছ সংরক্ষণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ গাছ অপসারণের ব্যবস্থা সিটি করপোরেশনকেই করতে হবে।
আমাদের নতুন সময়ে প্রকাশিত ; ১১ এপ্রিল, ২০১৯
0 Comments
Post a Comment