সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির আগে ‘নার্সারি শ্রেণি’ চালু করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রাণয়। কারণ হিসেবে মন্ত্রণালয় বলছে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শেণির আগেও একটি শ্রেণি রয়েছে, যা ‘প্রাক প্রাথমিক শ্রেণি’ নামে পরিচিত। ভর্তি হওয়ার বয়স পাঁচ বছর। তবে আজকাল অনেক অভিভাবক বাচ্চাদের বয়স তিন বা চার বছর হলেই স্কুলে ভর্তি করাতে চান। সেক্ষেত্রে শিশুকে দিতে হয় বেসরকারি কিন্ডারগার্টেনে। আর একবার কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি হলে শিশু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ফিরে আসতে চায় না। এ ধারায় বদল আনতে চাইছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এক্ষেত্রে প্রাক-প্রাথমিককে কেজি বা শিশু শ্রেণি ধরে এর আগে আরেকটি শ্রেণি নার্সারি চালুর পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। নার্সারিতে ভর্তির সর্বনিম্ন বয়স হতে হবে চার বছর।

অথচ দার্শনিক রুশো, অ্যারিস্টটল, প্লেটো থেকে শুরু করে আধুনিক দার্শনিক অগাস্ট কোঁৎ, ফ্রান্সিস বেকন, জন ডিউই প্রমুখ বলেছেন, ‘শিশুদের ছয় বছরের আগে স্কুলে পাঠানো উচিত নয়।’ এটা তো পরীক্ষিত সত্য যে শিশুরা প্রথম পাঁচ বছর প্রকৃতির কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। আমরা লক্ষ্য করলে দেখব যে, আমাদের বাসার ছোট ছোট শিশুরা যতক্ষণ জেগে থাকে, ততক্ষণ একটার পর একটা বিষয় কিংবা জিনিস অথবা আসবাবপত্র নিয়ে সর্বদাই ব্যস্ত থাকে। একটার পর একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে, মুখের সামনে এনে দেখায়, জানতে চায় সেটি কী, কী কাজ করা হয় সেটি দিয়ে। সে একটি বস্তু নিয়ে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, আছাড় দেয়; সেখান থেকে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করে। এসবই প্রকৃতির শিক্ষা। এটিই একটি শিশুর সবচেয়ে বড় বিদ্যালয়, শেখার বড় জায়গা। আমরা সেই সবচেয়ে বড় বিদ্যালয় থেকে শিশুকে নিয়ে বন্দি করার ব্যবস্থা করছি কিন্ডারগার্ডেনের বদ্ধ প্রকোষ্টে। কিন্ডারগার্ডেন কিংবা প্রাক-প্রাথমিক যা-ই বলি না কেন, সেখানে মূলত শ্রেণিশাসিত দেখাশোনা, পড়াশোনা হয়ে থাকে; যা তার স্বাভাবিক বিকাশ ও জানার জগত ও পথকে শুধু সীমিত নয়, বাধাগ্রস্ত করে।

সুতরাং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচিত ছিল এই শিশুবিকাশবিরোধী নার্সারি, প্লে, প্রাক-প্রাথমিক ইত্যাদি ব্যবস্থা বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া। তা না করে মন্ত্রণালয় বরং কিন্ডারগার্টেনে শিশুদের গমন ঠেকাতে নিজেরাই কিন্ডারগার্টেনের স্রোতে গা ভাসাতে চাইছে!

ভেবে দেখা প্রয়োজন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশু ভর্তি না হওয়ার পেছনে কী শুধু ওই বয়সজনিত কারণই দায়ী? নাকি অন্যবিধ কারণও রয়েছে? দিন কয়েক আগে গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি খবর ছিল এরকম: প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোনো এক শিক্ষার্থীকে ইংরেজিতে ‘ইংলিশ’ বানান জিজ্ঞেস করলে সে তা বলতে পারেনি; পরে তিনি দেখলেন যে, শিক্ষকরাও তা পারেন না। একই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত আগের মন্ত্রী একবার দেখেছিলেন- পঞ্চম, চতুর্থ ও তৃতীয় শ্রেণির কোনো শিক্ষার্থীই তাদের শ্রেণির বানান ইংরেজিতে লিখতে পারেনি। এই যখন অবস্থা, তখন সহজেই বোঝা যায় যে, অভিভাবকরা কেন শিশুদেরকে নিয়ে কিন্ডারগার্টেনে গিয়ে থাকেন।

বগুড়ার এক প্রত্যন্ত ইউনিয়ন নশরৎপুরে রয়েছে বেশ ক’টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেখানকার এক অভিভাকের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘প্রাইমারি স্কুলে পরীক্ষার সময় প্রশ্নের উত্তর শিক্ষকগণ ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে দেন। যা দেখে দেখে ছাত্র-ছাত্রীরা খাতায় লিখে ভরাট করে।’ ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে প্রথম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ মালিহা নামের এক ছাত্রীর সঙ্গে কথা হলে সে বলে, ‘ম্যাডামরা বোর্ডে উত্তর লিখে দেন। বাসায় যেটা পড়ে গেছি তখন সেটা ভুলে যাই।’ বিষয়টি নিয়ে জনৈক শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলি। তিনি বলেন, ‘যদি বাচ্চারা পাশ না করে তবে জবাবদিহিতায় পড়তে হয়। তাই শিক্ষকগণ একটু আধটু বোর্ডে লিখে দেন।’

শুধু তাই নয়, দরিদ্র ছেলে মেয়েদেরকে পড়ালেখায় উৎসাহিত করার জন্য সরকার যেসব খেলার সামগ্রী, খাদ্যসামগ্রী ইত্যাদি প্রদান করে, সেসব সামগ্রী যেমন বিভিন্ন ধরনের খেলনা ও বিস্কুটের প্যাকেট ভ্যানিটি ব্যাগে করে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার সময় হাতে নাতে ধরা পড়েছেন অনেক শিক্ষক--নীলফামারিতে ঘটে যাওয়া এমন খবর বেরিয়েছে পত্রিকায়।

একটি জরিপে দেখা গেছে, একটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক উপস্থিতির হার ৬৫-৭০%; অর্থাৎ শিক্ষকগণ নির্ধারিত সময় ৯/৯.৩০টার পরিবর্তে আসেন ১০.৩০/১১.০০টার মধ্যে। আবার সপ্তাহে ৬দিনের মধ্যে ২দিন ২জন থাকেন না। কিন্তু কিন্ডার গার্টেন বিদ্যালয়ে শিক্ষক উপস্থিতির হার ১০০%। আর তারা সকাল ৭টায় বিদ্যালয়ে উপস্থিত হন। অনুপস্থিতির সংখ্যা সাপ্তাহিক ও অন্যান্য ছুটি ছাড়া নেই।

এসব ঘটনা প্রত্যক্ষ করার পর আর বলার সুযোগ নেই যে, শুধু তিন-চার বছর বয়সে শিশুকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ নেই বলে অভিভাবকরা কিন্ডার গার্টেনে শিশুদেরকে ভর্তি করান। বরং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি জনপ্রিয় না হওয়ার পেছনে উপরিল্লিখিত কারণগুলোর মতো আরও অনেক মৌল কারণ রয়েছে। প্রাক-প্রাথমিকে নার্সারি শ্রেণি চালুর পূর্বে মন্ত্রণাণলয়ের উচিত সেসব কারণ খতিয়ে দেখা।

সম্প্রতি খবরে প্রকাশ, শুধু ঢাকা মহানগরীতেই ৩৪২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আধুনিকায়নে মন্ত্রণালয় ১ হাজার ২৬৯ কোটি ২১ লাখ ৭ হাজার টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর আওতায় পুরনো বিদ্যালয়গুলোয় স্থাপন করা হবে আধুনিকমানের দৃষ্টিনন্দন বহুতল ভবন। এছাড়া বিদ্যালয়ের দেয়াল, জসজ্জাকরণ, আসবাবপত্র ক্রয়, ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন, সীমানা প্রাচীর নির্মাণ, নিরাপদ পানি সরবরাহ, অভ্যন্তরীণ রাস্তা নির্মাণ, সংযোগ সড়ক, চিলড্রেনস প্লে কর্নার, অগ্নিপ্রতিরোধসহ নানা আধুনিকায়নে বদলে যাবে রাজধানীর প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো। এছাড়া উত্তরা ও পূর্বাচলে নতুন করে আরও ১৪টি বিদ্যালয় স্থাপন করা হবে।

এ পদক্ষেপগুলো নিঃসন্দেহে প্রসংশনীয়। কিন্তু শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন যদি না করা যায়, শিক্ষকদের মানোন্নয়ন যদি না ঘটানো যায়, পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকে যদি জবাবদিহিতার অওতায় আনা না যায়, তবে শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন দিয়ে শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করা কখনোই সম্ভব হবে না।

আর কিন্ডারগার্টেনকে মোকাবেলা করার জন্য কিন্ডারগার্টেনের আদলে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে শ্রেণি বাড়ানোর মতো হঠকারি সিদ্ধান্ত বরং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে প্রশ্নবিদ্ধই করবে।

আমাদের নতুন সময়ে প্রকাশিত ; ৮ এপ্রিল, ২০১৯