বর্ধিত দুই দিনসহ এবারের বইমেলায় সবমিলিয়ে সতের দিন যাওয়া হলো। তাতে যে অভিজ্ঞতা হলো তাকে একশব্দে বলা যেতে পারে ‘অম্ল-মধুর’।
অম্লের কথা থাক, মধুর কথাই আগে বলি। এবারের মেলার স্টলবিন্যাস বিস্তৃত পরিসরে ছড়ানো ছিল, ফলে গা ঘেষাঘেষি ভীড় ছিল না। মানুষ স্বস্তি নিয়ে হাঁটতে পেরেছে। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে খানিক জিরোবার জন্য লেকের পাশের বেঞ্চগুলোতে বসার ফুসরৎ পেয়েছে। এমনকি স্বস্তিতে হাঁটা গেছে টিএসসি থেকে মেলায় প্রবেশের গেট পর্যন্ত পথেও। কারণ অন্যান্যবারের মতো এবার এই পথের দুপাশে চুড়ি-ফিতা-টিপ, ফুচকা-চানাচুর-বাদামের দোকান ছিল না।
তাই বলে কি মানুষের উপস্থিতি কম ছিল? মোটেও নয়। প্রথম সপ্তাহখানেক বইপ্রেমীদের আনাগোনা একটু কম মনে হলেও ৮ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার থেকে দৃশ্যত মানুষের ঢল নামে বইমেলায়। এদিকে শাহবাগ, ওদিকে নীলক্ষেত মোড় এবং অন্যদিকে দোয়েলচত্বর পর্যন্ত ছিল লোকে লোকারণ্য। যখন বলা হচ্ছে প্রযুক্তি মানুষকে বইবিমুখ করছে, পুঁজিবাদ মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছে সময়, তখন বইমেলায় এই জনসমুদ্র দেখতে পারা নিঃসন্দেহে এক মধুর অভিজ্ঞতা।
তো এই ঢল দেখে সচরাচর যা বলা হয়—‘মানুষ বই কেনে না, শুধু ঘুরতে আসে আর চটপটি-ফুচকা খেয়ে সেলফি তুলে বাসায় ফিরে যায়।’ কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতায় যা দেখা গেল তাতে এই অভিযোগকে যথার্থ মনে হলো না। প্রচুর মানুষকে দেখা গেল দুহাত ভর্তি করে বইয়ের ব্যাগ নিয়ে মেলা থেকে ফিরে যাচ্ছেন। বিশেষ করে তরুণরা বই কেনায় কার্পণ্য করছেন না, এমনটাই দেখা গেল এই বইমেলায়।
তো এই ঢল দেখে সচরাচর যা বলা হয়—‘মানুষ বই কেনে না, শুধু ঘুরতে আসে আর চটপটি-ফুচকা খেয়ে সেলফি তুলে বাসায় ফিরে যায়।’ কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতায় যা দেখা গেল তাতে এই অভিযোগকে যথার্থ মনে হলো না। প্রচুর মানুষকে দেখা গেল দুহাত ভর্তি করে বইয়ের ব্যাগ নিয়ে মেলা থেকে ফিরে যাচ্ছেন। বিশেষ করে তরুণরা বই কেনায় কার্পণ্য করছেন না, এমনটাই দেখা গেল এই বইমেলায়।
‘কী বই কিনলেন’ কৌতুহলবসত বেশ কজন তরুণ-তরুণীকে জিজ্ঞেস করে উত্তর পাওয়া গেল—‘অনুপ্রেরণাদায়ী বই, ক্যারিয়ার সংক্রান্ত বই, মুক্তিযুদ্ধের বই, প্রযুক্তি শেখার বই ইত্যাদি।’
মেলার স্টলগুলো ঘুরেও দেখা গেল এবার ফিকশনের পাশাপাশি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ননফিকশন বই এনেছেন প্রকাশকরা। ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞানের বই, প্রবন্ধ-নিবন্ধের বই ছিল চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বইয়ের প্রাচুর্যতা ছিল নিঃসন্দেহে একটি মন ভালো করার মতো ঘটনা। এসব বই দেদারসে বিক্রিও হয়েছে।
এবার কিছু অম্লের কথা বলা যাক। মেলার পরিসর বাড়ানো হলেও দর্শনার্থীদের বসার জন্য পর্যাপ্ত জায়াগা নির্ধারণ করা হয়নি, ওই এক লেকের পাশ ছাড়া। মেলার ভিতর একটিমাত্র স্থান ছিল বসার জন্য। খাবারের দোকান ছিল তিনটিমাত্র, যেখানে দাম ছিল লাগামছাড়া। কফি পাওয়া গেছে কিন্তু চা ছিল না মেলায়। চা ছাড়া কি লেখকদের আড্ডা জমে? আর পর্যাপ্ত ডাস্টবিন ছিল না, ফলে কফির মগ, কাগজ, বইয়ের প্যাকেট ইত্যাদি জঞ্জাল ছিল মেলার মাঠময় ছড়ানো।
সবচেয়ে তিক্ত যে অভিজ্ঞতা ছিল সেটি হচ্ছে, অনেক স্বনামধন্য প্রকাশনীর বইয়েও মুদ্রণ প্রমাদের ছড়াছড়ি। দুর্বল বাঁধাই। কোনো কোনো বইয়ের মাঝখান থেকে আবার দু-চার পৃষ্ঠা উধাও! মেলার মধ্যেই এক প্রকাশনীর সামনে এক তরুণকে দেখা গেল বিক্রয়কর্মীর সঙ্গে বাহাস করতে। তাঁর অভিযোগ, ওই স্টল থেকে কেনা বিভূতিভুষণের চাঁদের পাহাড় বইয়ে ১৪ পৃষ্ঠার পর ৩০ পৃষ্ঠা। মাঝখানের পৃষ্ঠাগুলো নেই!
আরেক তরুণ লেখককে দেখলাম ফেসবুকে ক্ষেদোক্তি করেছেন এভাবে: ‘টাকা দিয়ে একি কিনলাম রে ভাই! পাতায় পাতায় ভুল বানান, বাক্যের গঠনও ভুল। প্রকাশক কি ছাপানোর আগে কিছুই দেখেন না?’
এইসব অভিযোগ নতুন কিছু নয়। প্রকাশকদের বিরুদ্ধে লেখক-পাঠকদের এন্তার অভিযোগ শোনা যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরেই। লেখকদের অভিযোগ, প্রকাশকরা লেককদেরকে বইয়ের হিসাবই দেন না, রয়্যালিটি প্রদান তো দূর অস্ত! প্রকাশকদের মুখস্ত উত্তর, বই বিক্রি হয় না। অথচ গত বছর শুধু বইমেলাতেই ৭০ কোটি টাকার ওপর বই বিক্রি হয়েছে বলে বাংলা একাডেমি হিসাব প্রকাশ করেছে। এভাবে পারস্পরিক অভিযোগের ভিত্তিতে একটি শিল্প দাঁড়াতে পারে না। বই প্রকাশের আগে লেখক-প্রকাশকের মধ্যে ন্যূনতম চুক্তি হওয়া উচিত।
আর বইয়ের কমিশনের বিষয়টি নিয়েও প্রকাশকদের ভাবা উচিত বলে মনে করি। পঁচিশ শতাংশ কমিশন মূলত বইয়ের দামের সঙ্গে যুক্ত করেই প্রকাশকরা একটি বইয়ের মূল্য নির্ধারণ করেন। ফলে বইয়ের দাম যায় বেড়ে। ১২০ পৃষ্ঠার বইয়ের দাম দাঁড়াচ্ছে ৩০০ টাকা। এত দাম দেখে পাঠক শুরুতেই হোঁচট খায়। তাই কমিশন প্রথা উঠিয়ে দেয়াই মঙ্গলজনক মনে করি। আবার কত ফর্মার দাম কতটুকু হবে সেটাও বোধহয় সৃনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করা নেই। এই মেলাতে ৯৬ পৃষ্ঠার একটি বই কিনলাম ৪০০ টাকা দিয়ে। অর্থাৎ প্রতি ফর্মার (১৬ পৃষ্ঠার) দাম পড়ছে ৬০ টাকা! একটু বেশি হয়ে গেল না কী?
বেশ ক’বছর ধরে বইমেলার মূল অংশ চলে এসেছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। কিন্তু লিটলম্যাগ চত্ত্বরসহ কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানের স্টল রয়ে গেছে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে। লিটলম্যাগ একাডেমি প্রাঙ্গনে থাকার ফলে কিছুটা একঘরে হয়ে পড়েছে। এ অংশে পাঠকদের উপস্থিতি কম। লেখকদের আড্ডাও নেই। অথচ লিটলম্যাগ চত্ত্বরের প্রাণই হচ্ছে উঠতি লেখকদের আড্ডা। তাই লিটলম্যাগকে এভাবে একঘরে করে না রেখে মুল মেলার সঙ্গে যুক্ত করে দিলে ভালো হয়।
মেলার সময়সীমা নিয়ে প্রতিবছরই কথা ওঠে। বাণিজ্যমেলা বা অন্যান্য মেলা যদি সকাল থেকে শুরু হয়ে রাত ১০টা অব্দি চলতে পারে, বইমেলা কেন নয়? এ বিষয়টি মেলা কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখতে পারে। যদিও ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টা থেকে মেলা খোলা থাকে। এই নিয়ম পয়লা ফাল্গুনের দিনেও চালু করলে মন্দ হয় না। কারণ এদিন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সকাল থেকেই প্রচুরসংখ্যক মানুষ বেড়াতে আসেন। এই সুযোগে তাঁরা বইমেলা থেকে বই কেনার সুযোগ গ্রহণ করতে পারবেন।
মেলার সময়সীমা নিয়ে প্রতিবছরই কথা ওঠে। বাণিজ্যমেলা বা অন্যান্য মেলা যদি সকাল থেকে শুরু হয়ে রাত ১০টা অব্দি চলতে পারে, বইমেলা কেন নয়? এ বিষয়টি মেলা কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখতে পারে। যদিও ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টা থেকে মেলা খোলা থাকে। এই নিয়ম পয়লা ফাল্গুনের দিনেও চালু করলে মন্দ হয় না। কারণ এদিন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সকাল থেকেই প্রচুরসংখ্যক মানুষ বেড়াতে আসেন। এই সুযোগে তাঁরা বইমেলা থেকে বই কেনার সুযোগ গ্রহণ করতে পারবেন।
মেলায় প্রবেশপথ মাত্র দুটি। এটি যদি আরও বাড়ানো যায় তাহলে মেলার প্রবেশমুখে ভীড় এড়ানো যেত, তাই নয় কি?
বই জ্ঞানের বাহন। বই একটি জাতির মননশীলতা তৈরি করে। তাই বইমেলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উপরোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে মেলাকর্তৃপক্ষ যদি আরো যত্নের সঙ্গে মেলা আয়োজন করতে পারে তবে মেলাতে বইক্রেতাদের সংখ্যা আরো বাড়বে যা আখেরে জাতির জন্যই মঙ্গলজনক।
0 Comments
Post a Comment