![]() |
| প্রচ্ছদ : হান্নাহ কুরান। সূত্র : পিক্সেলস |
বৃষ্টিটা ঝেঁপে নামতে যেন লজ্জা পাচ্ছে। যেন উঠোনে নাচতে নেমে লজ্জায় ঘোমটা টেনে দিয়েছে নতুন বউ। নতুন বউয়ের খ্যামটার তালে-লয়ে একটু-আধটু গরমিল হয়ে গেলেও দর্শকরা যেমন হাততালি সহযোগে উপভোগ করে নাচ, আমরাও তেমনি এই লজ্জাবতী বৃষ্টিটাকে উপভোগ করতে শুরু করি।
এ বৃষ্টির নাম ঝিরঝির বৃষ্টি। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের মতো হোঁচট খেয়ে খেয়ে চলতে থাকা এ বৃষ্টিতে আমরা ভিজি। ভিজতে ভিজতে হাঁটি। হাঁটতে হাঁটতে গল্পের ঝুড়ি উপুড় করি। গল্পের ঝুড়ি উপুড় করা মানে হৃদয় মেলে ধরা।
এবারই, এই প্রথম নয় এমন বৃষ্টিমেদুর সন্ধ্যায় হৃদয়ের লেনা-দেনা। এবারই, এই প্রথম নয় এমন ভিজে মেঘের সন্ধ্যায় ভিজে ভিজে হাঁটাহাঁটি। আগেও আমরা এমন হৃদয় হাতে নিয়ে ভিজতে ভিজতে হেঁটেছি শহরের পথে পথে। সে শহরের নাম বগুড়া। কবে সে কোন বর্ষাকালে... আহা, কবে সে কোন বর্ষাকালে! সে সব স্মৃতি এখন সাত সমুদ্রের নিচের দৈত্যপুরীতে কৌটাবন্দি রাজকণ্যার প্রাণভোমরা। মাঝে মাঝে ডলিম কুমার হয়ে ডুব দেই সেই দৈত্যপুরীতে। তুলে আনি কৌটাটাকে। খুলে দেই কৌটার ডালা। আর প্রাণ ভরে দেখি স্মৃতির ভোমরার ওড়াওড়ি।
স্মৃতির ভোমরাটা এখন দেখাচ্ছে, বগুড়া নামের শহর। ঝিরঝির নামের বৃষ্টি। সন্ধ্যার আলো নিভে গেছে খানিক আগেই। আমরা হাঁটছিলাম। ঝিরঝির বৃষ্টিতে পাখিভেজা হয়ে হাঁটছিলাম। হাতে জ্বলছিল সিগারেট। কিন্তু কি আশ্চরর্য! সিগারেট ভিজছিল না! সিগারেটের আগুনও নিভছিল না!
অথচ আজ এই ঢাকার শহরে সেই অসম্ভব ঘটনাই ঘটল। সঞ্জু সবে সিগারেট ধরিয়েছে, অমনি একফোঁটা বৃষ্টি এসে সিগারেট নিভিয়ে দিলো! ধ্যাৎ! বলে সঞ্জু সিগারেটটা এগিয়ে দিলো আমার দিকে। আমি হাতের আড়াল করে বৃষ্টি বাঁচিয়ে ফের সিগারেট জ্বালালাম।
সঞ্জু হঠাৎ অন্যমনষ্ক হয়ে, আকাশে মুখ তুলে বলতে শুরু করল, এখন তুমি কোথায় আছ কেমন আছ পত্র দিয়ো... পত্র দিয়ো...।
আমি জানি এই ‘তুমি’টা কে। আমি জানি, এই তুমি মানে এক ঘুমিয়ে থাকা রাজকণ্যা। আমি জানি, সোনার কাঠি রূপোর কাঠি ছুঁইয়ে এ রাজকণ্যার ঘুম ভাঙানোর সাধ্য সঞ্জুর নেই। আমি আরও জানি, সঞ্জু কোনোদিনই ডালিম কুমার হতে পারবে না।
তবু দুর্বল মন না মানে যুক্তি। ভাবি, নতুন কোনো রাজকণ্যে এল না তো সঞ্জুর জীবনে!
আমার ভঙ্গিটা নিঃসন্দেহে অসহায়, কিন্তু স্থির চোখে সঞ্জুর চোখের অতলে বরশি ফেলি। বড় মাছ নয়, চুনোপুটি ধরারই আশা করি। কিন্তু বৃষ্টির ফোঁটায় অশ্রুর ফোঁটায় সঞ্জুর চোখের সিন্ধু ভেসে একাকার। আমি সেখানে সেই পুরনো মীনকুমারীর উচ্ছ¡ল ডুবসাঁতার ছাড়া আর কিছুই দেখি না।
সঞ্জু হঠাৎ আমার হাত দুটো চেপে ধরে। বিশেষ পোশাকধারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়া নিরপরাধ জনতার মতো কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, হে দশ দিক, আমি কোনো পাপ করিনি। আমি কোনো অন্যায় করিনি। তবু কেন সে যোগাযোগ...।
সঞ্জু আর বলতে পারে না। আমি বুঝতে পারি একটা কান্নার পাথর ওর গলায় আটকে গেছে। মাঝে মাঝে এমন হয়। এমন তো হয়ই মাঝে মাঝে। কষ্টের পাথর বুক থেকে গলায় উঠে এলে মানুষ নামের প্রাণিগুলো আর শ্বাস নিতে পারে না। চোখ উল্টিয়ে কেমন করুণভাবে তাকায়।
সঞ্জু সেভাবেই তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি এখন কী করব? পাথর সরানোর বেলচা তো আমার কাছে নেই! তবে আমি বিশ্বাস করি, প্রতিটি মানুষের কষ্ট সরানোর নিজস্ব পদ্ধতি আছে। সঞ্জু কষে একটা টান দিলো সিগারেটে। কী জানি, গলা থেকে পাথরটা নামানোর চেষ্টা করছে হয়ত।
আমি চোখ ফিরিয়ে নিয়ে রাস্তার উল্টো দিকে তাকাই। ফুটপাত ভেসে যাচ্ছে ড্রেন থেকে উঠে আসা নোংরা জলে। ঠিক তার ওপরেই ল্যাম্প পোস্টের গায়ে ঝুলে আছে নগরপিতা নির্বাচনের বিলবোর্ড; তাতে এন্তার প্রতিশ্রæতি : হ্যান করেঙ্গা ত্যান করেঙ্গা...। আমার কেন জানি মনে হলো, ঢাকা একদিন তিলোত্তমা নগরী হবে আর সঞ্জু একদিন দুঃখ ভুলে জীবনের দিকে মুখ ফেরাবে---দুটোই প্রায় সমার্থক শব্দ (দূরাশা অর্থে)।
একটা দীর্ঘ হতাশ্বাস বাতাসে মিলিয়ে দিয়ে আমি আবার সঞ্জুর দিকে তাকাই। সঞ্জু ধীর গলায় বলতে শুরু করে, যতটা ধীর গলায় সিনেমার গানের স্যাড ভার্সন বাজে তেমন করে, ‘আজ কতদিন হয়ে গেল ওর কোনো খবর পাই না। না ফোন, না ইমেইল, না ফেসবুক। আমার এক একটা দিন কাটে মুখ থেকে অক্সিজেনের মাস্ক খুলে নেওয়া রোগীর মতো হাঁপাতে হাঁপাতে।’
সিগারেটে টান দিচ্ছিলাম আমি। এক রাশ ধোঁয়া ছেড়ে সঞ্জুর মুখটা অন্ধকার করে দেই। সঞ্জুর বিষণœ চেহারা দেখতে আমার একটুও ভালো লাগে না। তারপর মাথা নিচু করে বলি, আমি কী করতে পারি, বল?
সঞ্জুর গলা আরও ধীর লয়ে বাজতে শুরু করে, তুই কী একটু দেখবি চেষ্টা করে? কোনো খবর পাওয়া যায় কি না? আমার কিছু ভাল্লাগে না রে...।
যে জীবন অতলে ডুবে গেছে, পুড়ে গেছে ছাল-বাকল, সেই জীবন ভালো লাগার প্রলেপজড়ানো ছিলইবা কবে? জানতে ইচ্ছে করে আমার। আমি অতীতের অতলে ডুব দিয়ে দেখি, সেই বাল্য থেকে এই যুবা বয়স অবধি লম্বা সময়ে সঞ্জু কখনো ভালো লাগার মুখোমুখি হয়েছে কিনা। মনে পড়ে না আমার। একবার, সেই প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময়ে দেখেছিলাম, সঞ্চু খুড়িয়ে খুঁড়িয়ে স্কুলে আসছে। তার পা ফুলে ঢোল। কী হয়েছে তোর? জিজ্ঞেস করলে মাথা নিচু করে বলেছিল, আব্বা ফুটবল মনে করে আমারে লাত্থি দিয়েছে। আরেকবার, কলেজ পাশ করার পর, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময় ওর আব্বা বলেছিল, তোর জন্য এক পয়সাও খরচ করতে পারব না। পড়ালেখার ইচ্ছা থাকলে নিজের চেষ্টায় কর। তখন বড়ভাই বিদেশ থেকে বলেছিল, তোর সব দায়িত্ব আমার। কিন্তু হায়! ছয়মাস পরই বড়ভাই ভুলে গিয়েছিল তার দায়িত্বের কথা। বড় আমানুষিক পরিশ্রম করে পরের পাঁচটি বছর চলতে হয়েছে সঞ্জুকে। এই ঢাকার শহরে নিজের পড়ালেখার খরচ নিজে জুগিয়ে চলা কি যে ঝক্কি! সেই ঝক্কি সামলানোর সময়ই অবশ্য পাশে দাঁড়িয়েছিল পুষ্প। কী মায়ায়, কী ভালোবাসায় সঞ্জুকে জড়িয়ে রেখেছিল মেয়েটা।
: টিউশনি একটা কমিয়ে দাও। এত পরিশ্রম তোমার শরীর নিতে পরছে না। আয়নায় চেহারাটা দেখেছ একবার?
: ব্যাপার না। মাত্র তো আর কয়েকটা বছর।
: শোনো, আমি একটা কলসেন্টারে কাজ নিয়েছি। পার্ট পাইম। তুমি একটা টিউশনি ছেড়ে দাও।
: কি আশ্চর্য! তুমি কেন চাকরি নিতে গেছ? বাসায় যখন জানবে তুমি পড়ালেখা বাদ দিয়ে চাকরি করছ, তখন কি জবাব দেবে?
: পড়ালেখা বাদ দেব কেন? কি বলো এসব! চাকরিটা তো পার্ট টাইম। প্রতিদিন ক্লাস শেষ করে বিকেলে যাব। আর বাসায় আমি ম্যানেজ করে ফেলব। ওটা নিয়ে টেনশন করো না। শোনো, তুমি একা একা এত পরিশ্রম করো, আর ভালো লাগে না। আমারও তো ইচ্ছে করে তোমাকে হেল্প করতে।
এভাবেই পাশে ছিল মেয়েটা। এভাবেই। আর এভাবেই একদিন সঞ্জুরও অনার্স শেষ হয়েছিল। তারপর সহজেই যে চাকরিটা পাওয়া যায় সেই মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ অফিসারের চাকরিটা নিয়েছিল সে। নতুন এক ওষুধ কোম্পানি। তারপরও ভালোই চলছিল। পুষ্পকে বলেছিল, একটা বছর সময় দাও। একটু গুছিয়ে নিয়েই সংসার শুরু করব আমরা। পুষ্প ‘আচ্ছা’ বলে প্রতিদিন নিউ মার্কেটের ঘর সাজানোর দোকানগুলো ঘুরে বেড়াত। ঘরের পর্দা কেমন হবে, বেড শিট কেমন হবে, সোফার কুশন এটা সেটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখত। কোনো কোনোদিন হাঁড়ি পাতিলের দোকানে ঘুরত। রাস্তায় হাঁটার সময় ‘টু লেট: ছোট ফ্যামিলি’ দেখলেই থমকে দাঁড়াত। দারোয়ানের কাছে গিয়ে শুনত ভাড়া কত, অ্যাডভান্স কত, দক্ষিণ দিকে জানলা আছে তো, আলো হাওয়া আসে তো, ইত্যাদি ইত্যাদি।
এতসব স্বপ্নের বাসা বুনে সেই পাখিটা একদিন উড়াল দিল। কোথায়? কেউ জানে না! পুষ্প ঝরে গেল। কোথায়? কে জানে! সঞ্জু উদভ্রান্ত হয়ে গেল। বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নিল, বান্ধবীদের কাছে খোঁজ নিল, কেউ কোনো সন্ধান দিতে পারল না। কয়েকদিন পর পত্রিকায় একটা খবর বের হলো: রাজধানী থেকে ১৩ মেয়ে নিখোঁজ!
কোথায় গেল, কীভাবে গেল কেউ কিছু বলতে পারছে না। পত্রিকাগুলো অনুমান করে লিখেছে, এটা হয়তো নারী পাচারকারী চক্রের কাজ। পুলিশ বলছে, ঘটনার হদিশ জানতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে তারা।
সঞ্জু বিশ্বাস করতে চায় না, ওই তেরজন মেয়ের একজন পুষ্প। হতেই পারে না। এটা অসম্ভব। সঞ্জু হু হু করে কেঁদে ওঠে, আমার কিছু ভাল্লাগে না... আমার কিছু ভাল্লাগে না...।
আমার হৃদয়টা সমবেদনা ফেরি করা মানবাধিকার সংস্থা নয়, তাই সত্যি সত্যি হু হু করে ওঠে। এ হু হু কীসের জন্য, এ হাহাকার কার জন্য, আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। শুধু বুঝতে পারি, এক ঝলক রক্ত যেন হৃৎপিণ্ডের গোড়ায় হোঁচট খেল। যদিও আমি সন্ধ্যার সময়ই বশিরকে হোয়াটস অ্যাপে জানিয়ে দিয়েছি, অপহরণ করা ১৩ জনের মধ্যে পুষ্প নামের কেউ আছে কিনা জানাতে। বশির ঘণ্টা খানেক পর টেক্সট পাঠিয়েছে, ‘বস, ইশরাত জাহান পুষ্প নামের একজন আছে।’ আমি সঙ্গে সঙ্গে ফিরতি মেসেজ পাঠিয়েছি---‘ছবি পাঠাও, এখনই।’ কিন্তু বশির এখন অব্দি কোনো উত্তর দেয়নি। যদ্দুর জানি, প্রথম দিনেই বর্ডার পার করে কলকাতায় মেয়েগুলোকে পাঠিয়ে দিয়েছে আন্তর্জাতিক নারী পাচারচক্রের বাংলাদেশি নেতা বশির বাহদুর। আমি কীভাবে জড়িয়ে পড়লাম এই চক্রের সঙ্গে, সে আরেক গল্প।
যাইহোক, আমি সঞ্জুর দিকে সিগারেট এগিয়ে দিয়ে ওর কাঁধে হাত রাখি। কুয়োর গভীর থেকে উঠে আসা শব্দের মতো শীতল আর নিস্পৃহ কণ্ঠে বলি, আজ রাতেই খবর নেব। বলতে গিয়ে টের পাই, গলায় আটকে গেছে একটা কিছু। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। চোখ উল্টিয়ে তাকাই সঞ্জুর দিকে। আমাকেও কী এখন খুব করুণ দেখাচ্ছে?
সিগারেটে টান দিচ্ছিল সঞ্জু। ঘাড় বাকিয়ে আমার দিকে তাকালো। তারপর কোনো কথা না বলে এক রাশ ধোঁয়া ছেড়ে আমার মুখটা অন্ধকার করে দিল।
কে জানে, আমার বিষণ্ন চেহারা দেখতে সঞ্জুরও হয়ত ভালো লাগে না!

0 Comments
Post a Comment