বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাজ মূলত দুটি--এক. জ্ঞান সৃষ্টি করা এবং দুই. সৃষ্ট জ্ঞানকে ছড়িয়ে দেওয়া। এবং এই নিয়মই বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত। কিন্তু বাংলাদেশই একমাত্র বিরল বৈচিত্রপূর্ণ দেশ যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নেতা সৃষ্টি করে। নেতা সৃষ্টি করা, বিশেষত রাজনৈতিক নেতা সৃষ্টি করা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে কিনা সেই প্রশ্ন সাম্প্রতিক ডাকসু নির্বাচনকে ঘিরে আবারও জনমনে দেখা দিয়েছে।

অনলাইনের এই সুলভ যুগে গুগল ঘেঁটে জানা গেল, বিশ্বের উন্নত দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সংগঠন বা ইউনিয়ন আছে। সেগুলোতে নিয়মিত নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়, ২৮ বছর ধরে অপেক্ষা করতে হয় না। তারা মূলত নির্বাচন করে একটি প্যানেল তৈরির প্রয়োজনে, যাদের কাজ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় যেনো খেয়ালখুশি মতো শিক্ষার্থীদের ওপর টিউশন-ফিসহ অন্যান্য খরচ বাড়াতে না পারে এবং শিক্ষার্থীদের কোনো ইস্যুতে সমস্যা হলে সেটি বলার মতো একটি প্লাটফর্ম থাকে। 

গেল মাসেই অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং সে নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শিক্ষার্থী আনিশা ফারুক। আর ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন রে উইলিয়ামস। কিন্তু সেই
নির্বাচন নিয়ে অক্সফোর্ডের উপাচার্যকে জাতীয় মিডিয়ার সামনে বিবৃতি দিতে দেখা যায়নি। সেদেশের মিডিয়াকেও দেখা যায়নি বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের একটি নির্বাচনকে জাতীয় ইস্যু হিসেবে প্রচার করতে।

তো এই আনিশা কিংবা উইলিয়ামকে সে দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তৈরি করার জন্যই কী অক্সফোর্ড এই নির্বাচন করেছে? মোটেও না। কারণ সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো শিক্ষার্থী শাখা নেই। যাঁরা নির্বাচিত হলেন তাদের সঙ্গে সে দেশের মূলধারার রাজনীতির কোনো যোগাযোগ নেই। কিন্তু বাংলাদেশে প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এখানে শিক্ষার্থীদের সংগঠন কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের শাখা সংগঠন হিসেবে কাজ করে। সোজা কথায় যাকে বলে লেজুরবৃত্তি। ফলে শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ের চেয়ে দলের স্বার্থ রক্ষা প্রাধান্য পায় এসব ছাত্রসংগঠনের নেতাদের কাছে। ফলত খুবই যৌক্তিক এবং প্রাসঙ্গিকভাবে প্রশ্ন উঠেছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব ছাত্রসংগঠনের প্রয়োজন আদৌ আছে কি না।

স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে ছাত্ররাজনীতি ও শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের সংগঠন দুটো এক বস্তু নয়। শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের যখন প্রয়োজন হয় তখন শিক্ষার্থীদের একত্রিত হতে কোনো সংগঠন বা রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের প্রয়োজন হয় না। এরকম সময়ে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই নিজেদের প্রয়োজনে নিজেদেরকে সংগঠিত করে নেন। তার দৃষ্ঠান্ত আমরা ভ্যাট আন্দোলন, কোটা আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ও অন্যান্য ইস্যুতে প্রত্যক্ষ করেছি। এসব আন্দোলনের নেতৃত্ব কী কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংগঠন তৈরি করেছিল?

পরিচিত কয়েকজন রাজনৈতিক বিশ্লেষককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ডাকসু নির্বাচন নিয়ে তারা এত উত্তেজিত বা রোমাঞ্চিত কেন? উত্তরে তাঁরা জানালেন, ‘একজন ভবিষ্যৎ নেতা উঠে আসবে এই নির্বাচন থেকে সেজন্য তাঁরা উত্তেজিত।’ অর্থাৎ আমরা একজন নেতার জন্য অধীর অপেক্ষায় বসে আছি, আর সেই নেতা তৈরি করার জন্য শতকোটি টাকা খরচ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চালাচ্ছি!

বিস্ময়চিহ্ন দিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করছি বটে, তবে এ বাস্তবতা এড়ানোর উপায় নেই। বাস্তবতা হচ্ছে, দেশের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ছাত্রসংগঠন রেখেছে মূলত শিক্ষার্থীদের মাথায় একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ পাকাপাকিভাবে বসিয়ে দেওয়ার প্রয়োজনে এবং নিজেদের স্বার্থোদ্ধারের প্রয়োজনে সংগঠনগুলোকে লাঠিয়াল বাহিনী
হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। এই উদ্দেশ্যে তারা যে সফল তা তো আমরা চোখের সামনে দেখতেই পাচ্ছি। আপনি এমন একজন গ্রাজুয়েটকেও খুঁজে পাবেন না যিনি নিজস্ব রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে অজ্ঞ, কিন্তু তাকে যদি জিজ্ঞেস করেন উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য কী কিংবা দীর্ঘ চার-পাঁচ বছরে উচ্চশিক্ষা গ্রহণকালে আপনি যা শিখেছেন তা
বাস্তব জীবনে কীভাবে প্রয়োগ করবেন; উত্তর দিতে গিয়ে তিনি প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলবেন।

জানি, দেশের জাতীয় ইতিহাসে ডাকসুর একটি সমৃদ্ধ অবদান আছে---এমন উদাহরণ আপনারা সামনে আনবেন। আপনারা বলবেন, ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা যুদ্ধ ও নব্বুয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রসংগঠনের গৌরবময় ইতিহাস আছে। সেসব ইহিতাস ও অবদানকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করেই বলি, সামনে এগিয়ে যাওয়ার দুটো উপায় বেশ স্বীকৃত। একটি হচ্ছে, গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে উন্নত চিন্তা করা এবং অপরটি হচ্ছে, তেমন চিন্তা করতে না পারলে একটি আদর্শ মডেলকে সামনে রেখে তাকে অনুসরণ করা। আমরা যেহেতু এখনো বিশ্বের উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো চিন্তা করার সক্ষমতা অর্জন করতে পারিনি, সেহেতু আমাদের উচিত অন্তত তাদরেকে অনুসরণ করে সামনে এগিয়ে যাওয়া।

ভেবে দেখুন, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের উপাচার্য থেকে শুরু করে প্রভোস্ট, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, দেশের মিডিয়াসকল এমনকি আপামর জনসাধারণ ডাকসু নির্বাচন নিয়ে উৎকণ্ঠিত, অথচ লেখাপড়া যে দিনের পর দিন গোল্লায় যাচ্ছে সেটি নিয়ে কারো কোনো শিরপীড়া নেই! বছরের পর বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রাজনৈতিক নেতা আর সরকারি আমলা তৈরি করে যাচ্ছে, যেন আর কোনো কাজ নেই বিশ্ববিদ্যালগুলোর। আর এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলারও কেউ নেই। বিষয়টি দুশ্চিন্তার।

দিনকয়েক আগেই গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি বিষয়ে গণশুনানী হয়ে গেল। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আসলে উদ্দেশ্য কী তা নিয়েও এমন গণশুনানী বা জরিপ হওয়া উচিত বলে মনে করি। জরিপ হওয়া উচিত যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী তথা শিক্ষিত ও দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরি করবে নাকি শুধুই রাজনৈতিক নেতা ও সরকারি আমলা তৈরি করবে?

দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত; ২৯ মার্চ, ২০১৯