![]() |
নশরৎপুর স্টেশন। ছবি : সংগৃহীত |
নির্বাচনী হাওয়ায় দুলছে সারা দেশ। শহর-নগর, বন্দর-গ্রাম সর্বত্র একই আলোচনা। এই যে বগুড়া জেলার আদমদীঘি উপজেলায় অপেক্ষাকৃত প্রান্তিক এক ইউনিয়ন নশরৎপুর, সেখানকার বাতাসও এখন মুখরিত ভোটের কলরবে। সড়কপথে নশরৎপুর ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে যেতে হলে মুরইল বাসস্ট্যান্ডে নামতে হয়। সেখান থেকে প্রায় এক কিলোমিটার পথ ভ্যান-রিকশায় যাওয়া যায়। মুরইল টু নশরৎপুর বাজার নামের এই সড়কটি ভয়াবহরকমের দুর্দশাগ্রস্থ। কতদিন যাবৎ এ অবস্থা ? এমন প্রশ্নের উত্তরে স্থানীয়রা জানালেন, তা প্রায় সাত-আট বছর তো হবেই।
এখানে স্থানীয় সরকার প্রশাসন রয়েছে, চেয়ারম্যান, মেম্বার রয়েছেন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি রয়েছেন, তারপরও কেউ কেন রাস্তাটি সংস্কারের উদ্যোগ নেননি, সে রহস্যের সমাধান অল্প সময়ে করা গেল না। সাধারণ মানুষও সম্ভবত সচেতনভাবে কোনো উদ্যোগ নেননি। যদিও এ ছোট্ট ইউনিয়নে কলেজ ১টি, উচ্চবিদ্যালয় ৪টি, মাদ্রাসা ২টি, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ১০টি, বেসরকারি ৫টি এবং কিন্ডারগার্টেন ২টির অবস্থান থেকে অনুমান করা যায় যে এ অঞ্চলে শিক্ষার হার ভালো। তারপরও মানুষ কেন সচেতনতার তাগিদ থেকে বিগত দশ বছরে রাস্তাটির সংস্কারের জন্য একবারও কোনো মানববন্ধন বা জনপ্রতিনিধির কাছে কোনো স্মারকলিপি প্রেরণ করেননি? প্রশ্নটি করেছিলাম মুরইল থেকে ভ্যানে চেপে নশরৎপুর বাজারে যেতে যেতে স্থানীয় একজন যুবককে, যিনি সম্প্রতি বগুড়ার সরকারি আযিযুল হক কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাসে স্নাতকোত্তর পাশ করেছেন। উত্তরে তিনি বললেন, ‘মাস্টার্স পাশ করে তিন বছর ধরে বসে আছি। একের পর এক চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছি। চাকরি তো আর হয় না! জীবন না বাঁচলে এলাকা নিয়ে ভাববো ক্যামনে?’
নশরৎপুর বাজারে নেমে দেখা গেল, ছোট্ট মফস্বলী এক বাজার। কাপড়-চোপড়ের দোকান, মুদি দোকান, কাঁচা বাজার, ফার্মেসি, সেলুন থেকে শুরু করে সবধরনের দোকানই আছে এই বাজারে। ডিজিটাল হাওয়া লেগেছে এখানেও। পাওয়া গেল একটি ইন্টারনেটের দোকান। বাহ্! জরুরি একটি মেইল তাহলে এখনই করা যাক। কিন্তু যতটা আনন্দচিত্তে মেইল করতে গেলাম, ঠিক ততোটাই হতাশ হতে হলো। গতিহীন ইন্টারনেট। মেইল ‘লোডিং’ হতে হতে বেলা পড়ে যাওয়ার জোগাড়!
দোকানি যুবক হাসতে হাসেত বললেন, ‘চা-টা খেয়ে আসতে পারেন। মেইল সেন্ড হইতে সময় লাগবে।’ বাজারে চায়ের দোকান রয়েছে বেশ ক’টি। যুবকের সৎ পরামর্শ অনুযায়ী একটা চায়ের দোকানে চা খেতে গিয়ে দেখা হয়ে গেল এলাকার কয়েকজন প্রবীণের সঙ্গে। চা খেতে খেতে অলস আড্ডা দিচ্ছেন তারা। আড্ডার বিষয়বস্তু যথারীতি রাজনীতি।
‘এত যে ভোট ভোট করতেছিস, ভোট কী অসলেই হবে? ক্যামনে শিউর হইলি?’ একজনের কণ্ঠ থেকে সংশয় ঝরে পড়ে। আরেকজন আশ্বস্ত করেন, ‘হবে হবে। এইবার ঠিকই ভোট হবে। সব দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, দেখতেছেন না ?’
চা বানাতে বানাতে ভয়মিশ্রিত গলায় মাঝবয়সী দোকানী মোয়াজ্জেম যোগ দেন তাদের আলোচনায়, ‘ভোট হলেও আবার আগের বারের মতো মারামারি হয় কিনা কে জানে!’
তাদের কথাবার্তা থেকেই জানা গেল, ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে যে অবর্ণনীয় তা-বলীলা সংঘটিত হয়েছিল, তার ছিটেফোঁটা এসে লেগেছিল এই নশরৎপুরেও। এখানে ট্রেনের হুসপাইপ খুলে ফেলা হয়েছিল, রাস্তায় টায়ার পোড়ানো হয়েছিল ইত্যাদি। সেই অবস্থা আবার ফিরে আসবে কিনা এমন আতঙ্কের কথাই বলছিলেন চা দোকানদার।
এই বাজারের পাশেই রয়েছে একটি রেল স্টেশন। নশরৎপুর রেল স্টেশন। সান্তাহার টু লালমণিরহাট রুটের এটি একটি স্টেশন। একসময় স্টেশনটি জনকোলাহলে জমজমাট থাকলেও বিগত কয়েক বছর ধরে এটি মৃত। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এখানে নেই কোনো স্টেশন মাস্টার। স্বেচ্ছায় ট্রেন এখানে দাঁড়ায় এবং স্বেচ্ছায় ছেড়ে চলে যায়। স্থানীয়দের অবশ্য ট্রেনের সময়সূচি মুখস্ত। তারা সে অনুযায়ীই স্টেশনে অপেক্ষা করতে থাকেন।
৯টি ওয়ার্ড মিলিয়ে এই ইউনিয়নে ৩২ হাজার ৯১৮জন মানুষের বসবাস। বেশিরভাগ মানুষই কৃষিজীবী। ইউনিয়নে মোট কৃষিজমি আছে ৬ হাজার ৫১৪ দশমিক ৯৮ একর। প্রধান শষ্য ধান। ধানের তেমন দাম নেই। কিন্তু ফসলের উৎপাদন খরচ বেড়েছে তিনগুণ। কৃষক তমিজ মিয়া বলেন, আগে ৫০০ টাকায় দিনমজুর পাওয়া গেলেও এখন ৮০০-১০০০ টাকার কমে দিনমজুর পাওয়া যায় না। পানির দাম, সারের দাম সবকিছুই বেড়েছে। সবমিলিয়ে এখন এক বিঘা জমিতে ফসল ফলাতে কমপক্ষে ২০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। অথচ ধানের দাম মাত্র ৫০০ টাকা মন! সব ধান বিক্রি করেও খরচের টাকা ওঠে না।
‘ধরুন নির্বাচন হলো, অন্য কেউ ক্ষমতায় এলো, তাহলে কী অবস্থার পরিবর্তন হবে?’ প্রশ্ন করি।
‘ভোট হলেই কী আর না হলেই কী! হামাকেরে ভাগ্য জীবনেও বদলাবে না। আগেও তো ভোট দিছি। হামার জন্যি তো কেউ কিছু করেনি।’ কাটকাট উত্তর দিলেন বৃদ্ধ তমিজ মিয়া।
আমাদের নতুন সময়ে প্রকাশিত; ১০ ডিসেম্বর, ২০১৮
এখানে স্থানীয় সরকার প্রশাসন রয়েছে, চেয়ারম্যান, মেম্বার রয়েছেন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি রয়েছেন, তারপরও কেউ কেন রাস্তাটি সংস্কারের উদ্যোগ নেননি, সে রহস্যের সমাধান অল্প সময়ে করা গেল না। সাধারণ মানুষও সম্ভবত সচেতনভাবে কোনো উদ্যোগ নেননি। যদিও এ ছোট্ট ইউনিয়নে কলেজ ১টি, উচ্চবিদ্যালয় ৪টি, মাদ্রাসা ২টি, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ১০টি, বেসরকারি ৫টি এবং কিন্ডারগার্টেন ২টির অবস্থান থেকে অনুমান করা যায় যে এ অঞ্চলে শিক্ষার হার ভালো। তারপরও মানুষ কেন সচেতনতার তাগিদ থেকে বিগত দশ বছরে রাস্তাটির সংস্কারের জন্য একবারও কোনো মানববন্ধন বা জনপ্রতিনিধির কাছে কোনো স্মারকলিপি প্রেরণ করেননি? প্রশ্নটি করেছিলাম মুরইল থেকে ভ্যানে চেপে নশরৎপুর বাজারে যেতে যেতে স্থানীয় একজন যুবককে, যিনি সম্প্রতি বগুড়ার সরকারি আযিযুল হক কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাসে স্নাতকোত্তর পাশ করেছেন। উত্তরে তিনি বললেন, ‘মাস্টার্স পাশ করে তিন বছর ধরে বসে আছি। একের পর এক চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছি। চাকরি তো আর হয় না! জীবন না বাঁচলে এলাকা নিয়ে ভাববো ক্যামনে?’
নশরৎপুর বাজারে নেমে দেখা গেল, ছোট্ট মফস্বলী এক বাজার। কাপড়-চোপড়ের দোকান, মুদি দোকান, কাঁচা বাজার, ফার্মেসি, সেলুন থেকে শুরু করে সবধরনের দোকানই আছে এই বাজারে। ডিজিটাল হাওয়া লেগেছে এখানেও। পাওয়া গেল একটি ইন্টারনেটের দোকান। বাহ্! জরুরি একটি মেইল তাহলে এখনই করা যাক। কিন্তু যতটা আনন্দচিত্তে মেইল করতে গেলাম, ঠিক ততোটাই হতাশ হতে হলো। গতিহীন ইন্টারনেট। মেইল ‘লোডিং’ হতে হতে বেলা পড়ে যাওয়ার জোগাড়!
দোকানি যুবক হাসতে হাসেত বললেন, ‘চা-টা খেয়ে আসতে পারেন। মেইল সেন্ড হইতে সময় লাগবে।’ বাজারে চায়ের দোকান রয়েছে বেশ ক’টি। যুবকের সৎ পরামর্শ অনুযায়ী একটা চায়ের দোকানে চা খেতে গিয়ে দেখা হয়ে গেল এলাকার কয়েকজন প্রবীণের সঙ্গে। চা খেতে খেতে অলস আড্ডা দিচ্ছেন তারা। আড্ডার বিষয়বস্তু যথারীতি রাজনীতি।
‘এত যে ভোট ভোট করতেছিস, ভোট কী অসলেই হবে? ক্যামনে শিউর হইলি?’ একজনের কণ্ঠ থেকে সংশয় ঝরে পড়ে। আরেকজন আশ্বস্ত করেন, ‘হবে হবে। এইবার ঠিকই ভোট হবে। সব দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, দেখতেছেন না ?’
চা বানাতে বানাতে ভয়মিশ্রিত গলায় মাঝবয়সী দোকানী মোয়াজ্জেম যোগ দেন তাদের আলোচনায়, ‘ভোট হলেও আবার আগের বারের মতো মারামারি হয় কিনা কে জানে!’
তাদের কথাবার্তা থেকেই জানা গেল, ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে যে অবর্ণনীয় তা-বলীলা সংঘটিত হয়েছিল, তার ছিটেফোঁটা এসে লেগেছিল এই নশরৎপুরেও। এখানে ট্রেনের হুসপাইপ খুলে ফেলা হয়েছিল, রাস্তায় টায়ার পোড়ানো হয়েছিল ইত্যাদি। সেই অবস্থা আবার ফিরে আসবে কিনা এমন আতঙ্কের কথাই বলছিলেন চা দোকানদার।
এই বাজারের পাশেই রয়েছে একটি রেল স্টেশন। নশরৎপুর রেল স্টেশন। সান্তাহার টু লালমণিরহাট রুটের এটি একটি স্টেশন। একসময় স্টেশনটি জনকোলাহলে জমজমাট থাকলেও বিগত কয়েক বছর ধরে এটি মৃত। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এখানে নেই কোনো স্টেশন মাস্টার। স্বেচ্ছায় ট্রেন এখানে দাঁড়ায় এবং স্বেচ্ছায় ছেড়ে চলে যায়। স্থানীয়দের অবশ্য ট্রেনের সময়সূচি মুখস্ত। তারা সে অনুযায়ীই স্টেশনে অপেক্ষা করতে থাকেন।
৯টি ওয়ার্ড মিলিয়ে এই ইউনিয়নে ৩২ হাজার ৯১৮জন মানুষের বসবাস। বেশিরভাগ মানুষই কৃষিজীবী। ইউনিয়নে মোট কৃষিজমি আছে ৬ হাজার ৫১৪ দশমিক ৯৮ একর। প্রধান শষ্য ধান। ধানের তেমন দাম নেই। কিন্তু ফসলের উৎপাদন খরচ বেড়েছে তিনগুণ। কৃষক তমিজ মিয়া বলেন, আগে ৫০০ টাকায় দিনমজুর পাওয়া গেলেও এখন ৮০০-১০০০ টাকার কমে দিনমজুর পাওয়া যায় না। পানির দাম, সারের দাম সবকিছুই বেড়েছে। সবমিলিয়ে এখন এক বিঘা জমিতে ফসল ফলাতে কমপক্ষে ২০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। অথচ ধানের দাম মাত্র ৫০০ টাকা মন! সব ধান বিক্রি করেও খরচের টাকা ওঠে না।
‘ধরুন নির্বাচন হলো, অন্য কেউ ক্ষমতায় এলো, তাহলে কী অবস্থার পরিবর্তন হবে?’ প্রশ্ন করি।
‘ভোট হলেই কী আর না হলেই কী! হামাকেরে ভাগ্য জীবনেও বদলাবে না। আগেও তো ভোট দিছি। হামার জন্যি তো কেউ কিছু করেনি।’ কাটকাট উত্তর দিলেন বৃদ্ধ তমিজ মিয়া।
আমাদের নতুন সময়ে প্রকাশিত; ১০ ডিসেম্বর, ২০১৮
0 Comments
Post a Comment