জনপ্রিয় মার্কিন লেখক সাইমন ও সিনেকের একটি ভিডিও দেখার সৌভাগ্য হলো
সম্প্রতি, ইউটিউবের বদৌলতে। বোঝা গেল, ভিডিওটিতে তিনি বর্তমান প্রজন্মের
চারিত্রিক বৈশিষ্টকে মোটাদাগে চারটি পয়েন্টের মাধ্যমে সনাক্ত করেতে চেষ্টা
করেছেন। বৈশিষ্ট চারটি হচ্ছে: ১. সন্তান প্রতিপালনের ভুল পদ্ধতির মধ্য দিয়ে
এই প্রজন্মের বেড়ে ওঠা, ২. অনলাইন আসক্তি, ৩. তাৎক্ষণিকভাবে চাহিদা মিটে
যাওয়ার অভ্যাস এবং ৪. সামাজিক পরিবেশগত সমস্যা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও
বৈশিষ্ট্য চারটি নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।
![]() |
স্থিরচিত্র : দ্য ইকোনোমিস্ট |
প্রথমত: আমাদের মা বাবা (আশি পরবর্তী দশকের মা বাবার কথা বলা হচ্ছে) যে
পদ্ধতিতে সন্তান লালন পালন করেন তথা সন্তানকে বড় করে তোলেন, সেই পদ্ধতি
নিয়ে বিস্তর অভিযোগ এবং সমালোচনা রয়েছে। মা বাবা শুরু থেকেই তাদের
সন্তানদেরকে বোঝাতে শুরু করেন যে সে এই জগতের ‘স্পেশাল’ কিছু। সুতরাং যা মন
চায় তাই সে হতে পারবে। রাতদিন সন্তানের কানের কাছে এক শ্রেণির মা বাবা
ঘ্যান ঘ্যান করেন—তোমার যা হতে মন চায়, তুমি তাই হও। আর অপর শ্রেণি সরাসরি
বলেই দেন—তুমি ডাক্তার হও, তুমি ইঞ্জিনিয়ার হও, তুমি অমুক হও, তুমি তমুক
হও। কিন্তু এই উভয় শ্রেণির কেউই বলেন না, কোন কোন শর্ত পূরণ সাপেক্ষে মন যা
চায় তাই হওয়া যায় অথবা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়া যায়। তারা শুধু বলেন, ‘সফল
হও সফল হও’ এবং অবধারিতভাবে তাদের কাছে সফল হওয়ার সংজ্ঞা মানে প্রভূত
অর্থবিত্তের মালিক হওয়া। কিন্তু এই পিতৃমাতৃকূল ঘুণাক্ষরেও বলেন না, সফলতার
পথ কতটা দুস্তর পারাবার, কতটা সমস্যাসংকুল, কতটা সংগ্রামমুখর এবং কী উপায়ে
এই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পথ পাড়ি দেয়া যায়। তাই এই প্রজন্ম শুধু সফল হতে চাইতেই
শিখে, এর জন্য যে শর্তগুলো পূরণ করতে হয় সে ব্যাপারে কিছুই শিখে না। ফলে এই
শিশুগুলো এক অলীক আশাবাদ নিয়ে বড় হতে থাকে। এবং একসময় তারা যখন সত্যিকার
অর্থে বড় হয়, বাস্তবজীবনের মুখোমুখি হয়, অর্থাৎ কর্মজীবনে প্রবেশ করে তখন
চোখ থেকে ঠুস করে খসে পড়ে অলীক আশার ঝালর। সে টের পায়, সে আসলে স্পেশাল বা
বিশেষ কিছু নয়, জীবনের রূঢ় বাস্তবতা মোকাবেলা করার জন্য কোনো দক্ষতাই সে
অর্জন করেনি। সে তখন সংসার সমুদ্রে খাবি খায়। খড়কুটো ধরে বেঁচে থাকার
প্রচেষ্টা স্বরূপ মামা, চাচা, লবিং খুঁজে বেড়ায়। দিনশেষে তাই আমরা এ
প্রজন্মকে হতাশ হতে দেখি, বিমর্ষ হতে দেখি, হীনমন্যতায় ভুগতে দেখি এবং
আত্মহত্যা করতে দেখি।
এরপরের বিষয় অনলাইন আসক্তি বা সামাজিক যোগাযোগম্যাধ্যমাসক্তি যা নিয়ে
নতুন করে কহতব্য কিছু নেই। পৃথিবীব্যাপী এটিকে এক নতুন সমস্যা হিসেবে
চিহ্নিত করেছেন সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা। সমাজিক যোগাযোগমাধ্যমে
স্ক্রল করতে আমাদের ভালো লাগে। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ভালো লাগার
পেছনে একটি হরমোন কাজ করে যার নাম ‘ডোপামিন’। বলে রাখা ভালো, আরো যেসব
কারণে মানুষের শরীরে ডোপামিন নিঃসৃত হয় সেগুলো হচ্ছে: সিগারেক, মদ, জুয়া ও
অন্যান্য মাদকদ্রব্য। অর্থাৎ মাদকতার যে আনন্দ, সেই আনন্দ পাওয়া যায়
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। যারজন্য এই প্রজন্ম ক্ষণে ক্ষণে সামাজিক
যোগাযোগমাধ্যমে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার গোণে। অনলাইন আসক্ত এই প্রজন্ম তাই
যথেষ্ট সামাজিকীরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠার সুযোগ পায় না।
বয়ঃসন্ধিকালীন ও কৈশোরকালীন মানসিক পরিবর্তনের সময় যেসকল সামাজিক ও মানসিক
চাপ সামলাতে হয়, সেই সময় তারা চাপ ভুলে থাকার জন্য সামাজিক নেশা ফেসবুক,
টুইটার, ইন্সটাগ্রামে বুঁদ হয়ে থাকে। কাজেই দেখা যাচ্ছে, আমাদের এমন একটা
প্রজন্ম গড়ে উঠছে যাদের আত্মসম্মানবোধ গড়ে উঠছে না। তারা চাপ সামলানোর
কৌশলও শিখতে পারছে না সঠিকভাবে।
তৃতীয় বৈশিষ্ট্যের নাম ‘তাৎক্ষণিকভাবে চাহিদা মিটে যাওয়ার অভ্যাস’। একটু
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এই প্রজন্মের চাহিদা পূরণের জন্য খুব বেশি অপেক্ষা
করতে হয় না। ডিজিটাল এই প্রজন্মের কোনো কিছু কেনার জন্য হাটবারের জন্য
অপেক্ষা করতে হয় না, পায়ে হেঁটে দূরবর্তী কোরো মার্কেটে যেতে হয় না, একটু
একটু করে মাটির ব্যাংকে টাকাও জমাতে হয়। তাদের আছে অনলাইন মার্কেট,
চাহিবামাত্র হোম ডেলিভারি। পকেটে টাকা না থাকলেও ভাবনা নেই, আছে ক্রেডিট
কার্ড। কোনো একটা প্রিয় টিভি সিরিজ দেখার জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে
হয় না তাদের। ইউটিউবেই সব এপিসোড একসঙ্গে পাওয়া যায়। এইসব কারণে সহিষ্ণুতার
শিক্ষা ও অপেক্ষার আনন্দ এই প্রজন্মের জীবদ্দশায় নেই বললেই চলে। ফলতঃ তারা
গভীর জীবনবোধের অভাব ও হতাশাপ্রবণ এক প্রজন্ম হিসেবে গড়ে উঠছে।
সবশেষে নজর দেয়া যাক পরিবেশের দিকে। আমাদের চারপাশের পরিবেশ হয়ে উঠেছে
অতিমাত্রায় কর্পোরেট। এখানে সবকিছুই স্বল্পমেয়াদী লক্ষ্য নিয়ে করা হয়।
এখনকার সামাজিক পরিবেশ এই প্রজন্মকে পারস্পরিক আস্থা, বন্ধুত্ব স্থাপনের
কৌশল ইত্যাদি শিখতে মোটেও সাহায্য করছে না। অসহিষ্ণুতা থেকে বেরিয়ে আসতে
এবং দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য স্থির করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য যে প্রশিক্ষণ বা
ট্রেনিং দরকার, সেটার কোনো ক্ষেত্র সৃষ্টি করছে না এই কর্পোরেট সংস্কৃতি।
তাহলে দায় কার এই প্রজন্ম গড়ে পেছনে? প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। সবমিলিয়ে
বলতে হয়, উপরোক্ত চার বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন প্রজন্ম গড়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বেশি
দায়ী আমাদের প্রবীণ প্রজন্ম তথা আমাদের অভিভাবক সমাজ। তারা জীবনের
প্রতিপদে শুধু প্রতিযোগিতার শিক্ষা দিয়ে চলেছেন কিন্তু প্রতিযোগীতায় টিকে
থাকার কিংবা সৎভাবে প্রতিযোগিতায় উত্তরণের কৌশল শেখাতে ব্যর্থ হচ্ছেন।
আমাদের নতুন সময়ে প্রকাশিত, ৪ জানুয়ারি ২০১৯
0 Comments
Post a Comment