![]() |
স্থিরচিত্র : ইন্টারনেট |
দর্শন সংক্রান্ত বই পড়ার অভিলাস নিয়ে আপনি যখন উইল ডুরান্টের ‘দ্য স্টোরি অব ফিলোসফি’, বার্ট্রান্ড রাসেলের ‘হিস্ট্রি অব ওয়েস্টার্ন ফিলোসফি’, ডব্লিউটি স্টেইস-এর ‘এ ক্রিটিক্যাল হিস্ট্রি অব গ্রিক ফিলোসফি’র মতো কিছু বই করতলগত করবেন এবং কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে পড়ে ফেলবেন, তখন নিজের অজান্তেই আপনার মুখ থেকে বের হবে—বাংলা ভাষায় এ রকম বই নেই কেন?
প্রশ্ন সহজ,
উত্তর কঠিন।
মানুষের
ইতিহাস যতটা সরল, দর্শনের ইতিহাস ততটা সরল নয়। তবে ঐতিহাসিকরা যতটা দুর্বোধ্যরূপে
বয়ান করেন ততটা দুর্বোধ্যও আবার নয়। ব্যাপারটা বোঝার জন্য বার্ট্রান্ড রাসেলের
দারস্থ হওয়া যেতে পারে। রাসেল বলেছেন, ‘দার্শনিকগণ একইসঙ্গে কার্যকারণ এবং ফলাফলও।’
অর্থাৎ
দার্শিনিকরা তাদের সময়ের ঘাত-প্রতিঘাতের ফল। কোনো কোনো দার্শনিকের চিন্তাভাবনা
পরবর্তীতে তাদের দেশ ও সমাজ গ্রহণ করেছে। সেজন্য কোন দর্শন ও দার্শনিক সম্পর্কে আলোচনা
করার সময় তাঁর সময়কাল বা তাঁর সময়ের সঙ্কট, সমাজের ঘাত-প্রতিঘাতের ওপর আলো না ফেললে
তাঁর দর্শন বোঝা দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে।
প্রসঙ্গান্তরে
বলে রাখা ভালো, দর্শন শুধু স্কুলে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ারই বিষয় নয়, বরং এটা সমাজ ও
সম্প্রদায়ের অভিজ্ঞতা ও জীবনযাপনের অংশ। প্রতিটি সমাজ, দেশ বা সম্প্রদায়ের নিজস্ব দর্শন
রয়েছে, সেটা শক্তিশালী হোক কিংবা দুর্বল হোক। কেউ দর্শন জানুক বা না জানুক, দর্শন তাকে
নিয়ন্ত্রণ করে।
সুতরাং
জীবনে দর্শনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
বাংলা ভাষায়
দর্শন নিয়ে এমন কোন বই তালাশ করে পাওয়া যায় না, যে বইটি চোখ বন্ধ করে নতুন পাঠকের
হাতে তুলে দেয়া যায়। ফলে দর্শনের শিক্ষার্থী ছাড়া অন্যরা খুব সহজে দর্শনের
অনন্যসাধারণ জগতে প্রবেশ করতে পারে না।
দর্শনকে
অনেকে এক ধরনের প্রসারিত দৃষ্টিকোন থেকে দেখে থাকেন আবার অনেকে দেখেন একেবারে
শংকীর্ণ দৃষ্টিকোন থেকে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ব্যক্তির অবস্থানই তার দেখার
দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে দেয়। মানুষ আসলে ততটুকুই দেখে যতটুকু তার ক্ষমতা আছে বা ক্ষমতা
অর্জনের চেষ্টা করে। এ জন্য দর্শন সংক্রান্ত আলোচনার সময় দর্শনের বিস্তৃত ক্যানভাসটাই
মনে রাখা উচিত।
দর্শনের খ্যাতিমান
শিক্ষক ও গুরু বার্ট্রান্ড রাসেল মনে করেন দর্শনের সীমানাটা ধর্মতত্ত্ব ও বিজ্ঞানের
মাঝামাঝি ‘নো
ম্যানস ল্যান্ড’-এ। সবকিছুই নিশ্চিত জ্ঞান বিজ্ঞানের আওতাভুক্ত। এই নিশ্চিত জ্ঞানের বাইরের যে জগত সেখানে
প্রভূত্ব করে ধর্মতত্ত্ব। এই নিশ্চিত জ্ঞান ও অনিশ্চিত জগতের মাঝামাঝি যে জায়গা সেটা
দর্শনের ভাগে বরাদ্দ! যে প্রশ্নগুলোর জবাব নেই বিজ্ঞান বা ধর্মতত্ত্বের কাছে, সেগুলো
নিয়েই কায়কারবার দর্শনের। দর্শনের কিছু চিরন্তন প্রশ্ন হচ্ছে, ‘আমি কে? এই মহাবিশ্বের কোনো
উদ্দেশ্য আছে কি? মহাবিশ্ব কি কোনো নির্দিষ্ট পরিণতির দিকে ধাবিত হচ্ছে? প্রকৃতি ও
জগতের কি কোনো নিয়ম আছে? এ নিয়মগুলো কীভাবে গড়ে উঠল? মানুষের জীবনটা কেমন? এটা কি শুধু
সুখময় আর ভোগময়? নাকি শুধু কষ্টের? জীবনের ফলাফল বা অর্জন কি একটা বিশাল শূন্য? প্রজ্ঞা
বলতে কি কোনো জিনিস আছে? নাকি সেটাও আমাদের অজ্ঞতার পরিপূর্ণ বিকাশ? সত্য পথ বলতে কি
কোনো পথ আছে? নাকি সত্য পথও চিপাগলি হয়ে অন্ধকারেই ধাবিত হয়?
এই যে এমনতর
বিভিন্ন প্রশ্নগুলো, এগুলোর উত্তর বিজ্ঞানের গবেষণাগারে আবিষ্কার করা যায় না। বিভিন্ন
ধর্ম এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সামর্থ্য রাখে বলে দাবি করে। তাদের সেইসব নিশ্চিত উত্তরে
অনেক আধুনিক মন নিশ্চয়তা পায় না। এ প্রশ্নগুলোকে অধ্যয়ন করা দর্শনের কাজ। দর্শন সব
প্রশ্নের নিশ্চিত উত্তর দেয় বলে দাবি করে না বরং এগুলো নিয়ে অধ্যয়ন, অনুধ্যান বা গবেষণা
করে যায়।
তাই দর্শন
পড়া উচিত। দর্শন ভাবনার পথকে উন্মোচন করে।
0 Comments
Post a Comment