‘নারী ও বালিকাদের ক্ষমতায়ন, হোক
না তারা অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন’প্রতিপাদ্যকে উপজীব্য করে ২ এপ্রিল সাড়ম্বরে দেশজুড়ে পালিত হলো বিশ্ব
অটিজম দিবস। চলুন জানা যাক অটিজম কী, কেন, উদ্ভব ও এর বিকাশ।
আয়েশা আক্তার-নাসিমুল হক দম্পতি (ছদ্মনাম) ধরতে পারলেন না নিজের সন্তানের
সমস্যা। আর দশটি শিশুর মতো তাদের শিশুটিও স্বাভাবিক। ঠিক মতো কথা ফোটেনি তখনো। অথচ
একবার শুনেই ভাঙা ভাঙা শব্দে গাইতে পারত পুরো গান। তবুও শিশুটি যেন একটু অন্যরকম, অন্যসব
শিশুর চেয়ে। বড় ছেলেটা যেভাবে তাকায়, চোখের দিকে চোখ রাখে, সে রকম নয় সে। শিশুটিকে
নিয়ে যাওয়া হলো ডাক্তারের কাছে। কিন্তু রোগ সনাক্ত করা গেল না। অতঃপর একদিন আয়েশা ও
নাসিমুলের পরিচিত এক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ প্রথম ভুল ভাঙালেন সকলের। বললেন, শিশুটি অটিজম
রোগে আক্রান্ত।
বাংলাদেশে ক্রমশ বাড়ছে অটিজম রোগাক্রান্ত শিশুর সংখ্যা। তবে সেই সংখ্যা
ঠিক কতজন তা নির্ভুলভাবে বলার উপায় নেই। কারণ বাংলাদেশে অটিটিস্টক রোগীর সংখ্যার হিসাব
রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই; নেই কোনা নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান। পৃথিবীতে মাত্র চারটি দেশে
অটিস্টিকদের সংখ্যার হিসাব রাখার ব্যবস্থা আছে—যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া। সুতরাং আমাদের দেশে
মাঝে মাঝে পত্র পত্রিকায় অটিস্টিক রোগীদের যে সংখ্যা প্রকাশ করা হয় তা অনুমান নির্ভর।
যেমন অমুক দেশে তিন কোটি মানুষের মধ্যে এক লাখ অটিস্টিক; কাজেই বাংলাদেশের ষোল কোটির
মধ্যে পাঁচলাখ মানুষের অটিজম আছে।
তবে সংখ্যা যাই হোক, সেই সংখ্যা যে দিনকে দিন বাড়ছে তাতে কোনো সন্দেহ
নেই।
অটিজম কী?
অটিজম একটি নিউরোলজিক্যাল সমস্যা। কোনো সাইকোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার নয়।
১৯৭০ সালে প্রথম বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে জানা গিয়েছিল এই তথ্য। মনোবিজ্ঞানী নিউ ক্যানার
এর নাম দিয়েছিলেন অটিজম। ল্যাটিন শব্দ ‘অটিম’ এর অর্থ নিজের মধ্যে থাকা। শিশুর জন্মের প্রথম তিন বছরের মধ্যে দেখা
দেয় এ রোগটি। অটিজমে আক্রান্তদের মধ্যে প্রথমেই যে লক্ষণটি দেখা দেয় তা হলো, শাব্দিক
ও আকার ইঙ্গিতে যোগাযোগ অপারগতা। সমবয়সী সুস্থ শিশুদের সঙ্গে কিছুতেই মেশে না এরা।
অদ্ভূত কিছু দেখলে প্রকাশ পায় না কোনো প্রতিক্রিয়া। দেখা দেয় মনোযোগের সমস্যাও। বারবার
শরীরের অঙ্গ প্রতঙ্গ নাড়াচাড়া করা, হাত ঝাঁকানো, ঘাড় দোলানোও এ রোগের অন্যতম লক্ষণ।
কোনো বস্তুর প্রতি দেখা দেয় অকারণ আসক্তি। কিছুতেই মানতে চায় না রুটিন বা নিয়ম। আচরণে
পরিলক্ষিত হয় ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়া। আর শারীরিক বিপদ ও যন্ত্রণার ব্যাপারে ভীষণ অসংবেদনশীল
তারা। সাধারণ পরীক্ষায় কিছুতেই সনাক্ত করা যায় না রোগটিকে। কারণ এর মূল সমস্যা মস্তিষ্কের
সুক্ষ্ম কমিউনিকেশন সেন্টারের সোমালাইজেশনে। তাই অটিজম বিশেষজ্ঞরা সরাসরি মেডিকেল চিকিৎসার
দিকে না গিয়ে চেষ্টা করেছেন কীভাবে কাউন্সেলিংয়ের মধ্য দিয়ে সুস্থ করে তোলা যায় এ রোগে
আক্রান্ত শিশুদের।
ছয় পদ্ধতিতে চিকিৎসা
অটিস্টিক শিশুদের প্রাথমিক পর্যায়ে প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার জন্য মোট ছয়টি
পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
এক. মনোযোগের দক্ষতা। অটিস্টিক শিশুদের একটি মূল সমস্যা অমনোযোগিতা।
তাই প্রথমেই চেষ্টা করা হয় তাদের মনোযোগী করে তুলতে। শেখানো হয় কারো সাহায্য ছাড়াই
চেয়ারে বসতে। নাম ধরে ডাকার সঙ্গে সঙ্গে চোখে চোখে তাকাতে।
দুই. অনুকরণ দক্ষতা। অনুকরণ করতে করতেই এক সময় কাজের প্রতি অভ্যস্ত হয়ে
ওঠে অটিস্টিকি শিশুরা। তাই শরীরের অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে তাদের শেখানো হয় অনুকরণ করার
বিভন্ন কৌশল। শেখানো হয় ক্রেয়ন দিয়ে আঁকা, পেন্সিল দিয়ে লেখা ও মুখোভঙ্গির অনুকরণ।
তিন. ভাষা বোঝার দক্ষতা। যেহেতু মৌখিক যোগাযোগটা অসম্ভব এই শিশুদের জন্য,
তাই ভাষা বোঝার দক্ষতায় বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় তাদের। চিহ্নিত করতে শেখানো হয়
শরীরের অঙ্গ প্রতঙ্গ, বস্তু, ছবি ও পরিচিত ব্যক্তিকে। দক্ষ করে তোলা হয় আদেশ পালনে।
চার. ভাষা প্রকাশ করার দক্ষতা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অটিস্টিক শিশুরা
মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে না। তাই ভিন্ন পথে ভাষা প্রকাশে দক্ষ করে তোলা হয় এদের।
যেমন: পছন্দের বস্তুটি আঙুল দিয়ে দেখানো, শব্দ ও ভাষা অনুকরণ এবং বস্তু ও ছবির নাম
বলতে পারা। মৌখিকভাবে পছন্দের বস্তুটি চাওয়া। কথায় বা ইঙ্গিতে হ্যাঁ বা না বলা বা বোঝানো।
পরিচিত ব্যক্তিদের নাম বলতে পারা। তোমার নাম কী, কেমন আছ প্রভৃতি প্রশ্নের উত্তর দিতে
পারা।
পাঁচ. প্রি-একাডেমিক দক্ষতা। একই রকম বস্তু ও ছবি, একই বস্তুর সঙ্গে
একই ছবি, রঙ, আকৃতি, বর্ণমালা, সংখ্যা প্রভৃতির বিন্যাশ করতে শিশুদের বিশেষভাবে দক্ষ
করে তোলা হয়। ছোট কাজ কিংবা খেলা নিজে করতে পারা, রঙ ও আকৃতি চিনতে পারার বিষয়টিও তাদের
শেখানো হয়।
ছয়. নিজের কাজ নিজে করার দক্ষতা। অন্যান্য কাজের পাশাপাশি নিজের দৈনন্দিন
কাজ নিজে করার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। স্বাবলম্বী করে তোলা হয় কিছু খেতে, পরিধেয় বস্ত্র
খুলতে ও বাথরুমে যেতে। আগ্রহী করে তোলা হয় চুল আঁচড়ানো ও দাঁত পরিষ্কার করায়।
অটিজম এখন আর কোনো জটিল রোগ নয়। এই রোগটি থেকে মুক্তি পেতে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা
নিরন্তর গবেষণা করে যাচ্ছেন এবং তাদের অধিকাংশ গবেষণার ইতিবাচক ফল পেতে শুরু করেছে
অটিস্টিক শিশুরা। শুধু প্রয়োজন অসহায় এই শিশুদের প্রতি আমাদের সহানুভূতি, সহৃদয়তা ও
ভালোবাসা।
তথ্যঋণ: পিআইবি ও ইউনিসেফের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত পুস্তিকা ‘ফিচার সংকলন’ ও একাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক
গণমাধ্যম।

0 Comments
Post a Comment