দীর্ঘদিনের টিউশনির অভিজ্ঞায় দেখেছি, স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সামাজিকীকরণে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। নতুন পরিবেশে তারা সহজে খাপ খাওয়াতে পারে না। অপরিচিত মানুষকে কীভাবে সম্বোধন করতে হয়, জানে না। নবম শ্রেণিপড়ুয়া এক শিক্ষার্থীকে পড়ানোর সুযোগ পেয়েছিলাম বছরখানেক আগে। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, চালের কেজি কত করে এখন? রাজধানীর স্বনামধন্য এক স্কুলে পড়ুয়া সেই শিক্ষার্থী উত্তর দিতে পারেনি। এরপর কৌতুহলবসত একদিন মোহাম্মদপুরে একটি স্কুলের সামনে দাঁড়াই এবং জনা বিশেক ছেলেমেয়েকে জিজ্ঞেস করি, চালের দাত কত? কেউ বলেছে আঠারো টাকা, কেউ বলেছে পঁচিশ টাকা, কেউ বলেছে চল্লিশ টাকা। ঈদের ছুটিতে গিয়েছিলাম গ্রামে। সেখানেও নবম-দশম শ্রেণি পড়ুয়া কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, চালের কেজি কত করে? কেউই সঠিক উত্তর দিতে পারেনি। অর্থাৎ এই শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবইয়ের বাইরের জগৎ সম্পর্কে কিছুই জানে না!
অথচ এই জানানোটা জরুরি কি না? জিজ্ঞেস করেছিলাম রিপন রহমান নামের এক হাইস্কুল শিক্ষককে। তিনি আমার ফেসবুক বন্ধু। শিক্ষকতা করেন নাটোরের এক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। তিনি বলেন, ‘একাডেমিক ফল ভালো করানোর একটি চাপ থাকে আমাদের ওপর। সেই চাপ মোকাবেলা করতে গিয়ে আমাদের আসলে পাঠ্য বইয়ের ওপরই বেশি জোর দিতে হয়। ফলে ছেরেমেয়েরা আসলে ভালো রেজাল্ট নিয়েই বের হচ্ছে কিন্তু সামাজিকভাবে দক্ষ হিসেবে বের হচ্ছে না।’ এটার দায় অনেকটা অভিভাবকদেরও নিতে হবে বলে তিনি মনে করেন। কারণ, দিনশেষে অভিভাবকরা ছেলেমেয়ের কাছ থেকে ভালো রেজাল্টই আশা করেন।
![]() |
ছবি : বিডিনিউজ |
এই অভিযোগ নিয়ে সরাসরি কথা বলেছিলাম আমার সেই নবম শ্রেণি পড়–য়া শিক্ষার্থীর বাবার সঙ্গে। তিনি মৃদু হেসে বলেন, ‘অবশ্যই রেজাল্টটাই আমরা চাই। তা না হলে স্কুলের বাইরে আপনাকে কেন হাউজ টিউটর হিসেবে রেখেছি? রেখেছি এজন্য যে, ছেলেটির গোল্ডেন ফাইভ যেন মিস না হয়।’
এরপর অবশ্য ভদ্রলোক ব্যখ্যা করে বলেছিলেন, কেন জিপিএ ফাইভ চান। তাঁর মতে, এই চাওয়াটা তৈরি হয়েছে সামজিক কারণে। জিপিএ ফাইভের একটা সোস্যাল ভ্যালু রয়েছে। এটা না পেলে সমাজে মুখ দেখানো যায় না। তাছড়া চাকরি বাকরি থেকে শুরু করে সবক্ষেত্রে প্রবেশের প্রথম যোগ্যতাই হচ্ছে একাডেমিক রেজাল্ট।
বুঝতে আর অসুবিধা হয় না যে, এসব কারণেই শুধু পাঠ্যপুস্তকের বিদ্যা নয়, বরং জীবনযাপনের উপযোগী বিদ্যা দান করাও যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাজ---এই সত্য ভুলতে বসেছে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। শহরের স্বনামধন্য স্কুলগুলো শুধু গোল্ডেন ফাইভ অর্জনের বিদ্যা শেখায়, আর কিছু নয়। অথচ একজন মানুষকে সমাজের মধ্যে বেঁচে থাকতে হলে নানান মানুষের সঙ্গে মিশতে হয়, নানা পরিবেশে যেতে হয়, হাটে বাজারে যেতে হয়, চাকরি করতে যেতে হয়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যেতে হয়, বন্ধুর আড্ডায় যেতে হয়, বসের পার্টিতে যেতে হয়, কখনো কখনো লোকাল বাসে উঠতে হয়। ইত্যাদি। এসব কাজে ও পরিবেশে যথাযথ আচরণ করতে হয়, যার নাম সামাজিকতা। এই সামাজিকতা শেখার যে প্রক্রিয়া, তার নাম সামাজিকীকরণ।
সামাজিকীকরণ শুধু বইয়ের পাতা থেকে শেখা যায় না। এটা শেখার সবচেয়ে বড় দুটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে স্কুল ও পরিবার। শিশুরা সবচেয়ে বেশি সময় কাটায় এই দুটি জায়গাতেই। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, এই দুটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠানই সামাজিকীকরণ শেখাতে ক্রমশ ব্যর্থ হচ্ছে। স্কুলগুলো ব্যস্ত শিশুদের একাডেমিক ফল ভালো করানো নিয়ে। পরিবারগুলোও ব্যস্ত ওই একই উদ্দেশ্য নিয়ে। কিন্তু কেউই শিশুটিকে সামাজিক জীব হিসেবে দক্ষরূপে গড়ে তোলার ব্যাপারে ব্যস্ত নয়।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, শিশুকে নানাভাবে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমাজের উপযুক্ত সদস্য হিসেবে গড়ে তুলতে হয়। এই প্রক্রিয়ার নাম সামাজিকীকরণ। প্রক্রিয়াটি জীবনব্যাপী চলে। অর্থাৎ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত।
সমাজবিজ্ঞানী কিংসলে ডেভিস বলেছেন, সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানবশিশু পুরোপুরি সামাজিক মানুষে পরিণত হয়। এ প্রক্রিয়া ছাড়া শিশু তার ব্যক্তিত্বলাভে ব্যর্থ হয় এবং সমাজে সে একজন যোগ্য ও উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে না।
অগবর্ন ও নিমকফ কী বলেছেন? তাঁদের মতে, ‘সামাজিকীকরণ ছাড়া সমাজে জীবনযাপন একেবারেই সম্ভব নয় এবং সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার দ্বারা ব্যক্তি তার গোষ্ঠীর সঙ্গে মেলামেশায় সামাজিক মূল্যবোধ বজায় রাখে।’ অর্থাৎ মূল্যবোধ শেখারও একটি অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে সামাজিকীকরণ।
প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করেছন সমাজবিজ্ঞানী আরটি শেফার, ‘সামাজিকীকরণ হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে একটি নির্দিষ্ট সমাজের সদস্য হিসেবে ব্যক্তি তার নিজস্ব সমাজের মনোভাব, মূল্যবোধ এবং কার্যাবলি রপ্ত করে।’
এসব মন্তব্য থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া কতটা গুরুত্বপূর্ণ। অথচ দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপারটি হচ্ছে, এই গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারছে না আমাদের বিদ্যালয়গুলো এবং পরিবারগুলো।
0 Comments
Post a Comment